শ্রাবণ মেঘের দিন – হুমায়ূন আহমেদ
শ্রাবণ মেঘের দিন – srabon megher din হুমায়ূন আহমেদের অনেকগুলো উপন্যাসের মধ্যে একটি। এটিও বাকি উপন্যাস গুলোর মতো পাঠকদের মনে বিশালাকার ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এই উপন্যাসের অবলম্বনে একটি চলচিত্র নির্মান করেন হুমায়ূন আহমেদ যা সারাদেশে সাড়া ফেলে দেয় তখনকার সময়ে। এই চলচিত্রটি এখনো সমান ভাবে জনপ্রিয়। তাই দেরি না করে নিচের ডাউনলোড বাটনটিতে ক্লিক করে পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করে পড়া শুরু করে দিন।
Srabon Megher Din Ukti
কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে।কারণ ছাড়াই কথা বলতে ইচ্ছা করে তবে,মানুষটা বেশি সুন্দর হলে সমস্যা, বেশি সুন্দর।মানুষকে আপন বলে মনে হয় না পর পর লাগে।
হুমায়ুন আহমেদ (শ্রাবণ মেঘের দিন)
হুমায়ূন আহমদের জনপ্রিয় চরিত্র হিমু ও রুপা
“গরীবের আবার কষ্ট কিয়ের? কষ্ট বড়লোকের জিনিস।”
হুমায়ুন আহমেদ (শ্রাবণ মেঘের দিন)
মানুষের স্বভাব খানিকটা বোধহয় শামুকের মত। নিজের শক্ত খোলসের ভেতর মাঝে মাঝেই তাকে ঢুকে যেতে হয়। অতি প্রিয়জনের সঙ্গও সে সময় অসহ্যবোধ হয়
হুমায়ুন আহমেদ (শ্রাবণ মেঘের দিন)
হুমায়ূন আহমেদের আরও ৮০টি উক্তি দেখুন
শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাসের কিছু অংশ
নীতু বলল, আপা, আমার ভয় ভয় লাগছে।
শাহানার চোখে চশমা, কোলে মোটা একটি ইংরেজি বই–The Psychopathic Mind. দারুণ মজার বই। সে বইয়ের পাতা উল্টাল। নীতুর দিকে একবারও না তাকিয়ে বলল, ভয় লাগার মত কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
গা জ্বলে যাবার মত কথা। কি রকম হেড মিসট্রেস টাইপ ভাষা–ভয় লাগার মত কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। অথচ পরিস্থিতি যথেষ্টই খারাপ। তারা দুজন একা একা যাচ্ছে। দুজন কখনো একা হয় না, সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ নেই বলে নীতুর কাছে একা একা লাগছে। ঠাকরোকোনা স্টেশনে বিকেলের মধ্যে তাদের পৌঁছার কথা। এখন সন্ধ্যা, ট্রেন থেমে আছে। ঠাকরোকোনা, স্টেশন আরো তিন স্টপেজ পরে। যে ভাবে ট্রেন এগুচ্ছে, নীতুর ধারণা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দুপুর হয়ে যাবে। তখন তারা কি করবে? স্টেশনে বসে। ভোর হবার জন্যে অপেক্ষা করবে? মেয়েদের বসার কোন জায়গা আছে কি? যদি না থাকে তারা কোথায় বসবে?
নীতু বলল, আপা, তুমি বইটা বন্ধ কর তো।
শাহানা বই বন্ধ করল। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলল। শাহানার বয়স চবিবশ। তার গায়ে সাধারণ একটা সূতির শাড়ি। কোন সাজসজ্জা নেই অথচ কি সুন্দর তাকে পাগছে! নীতু কিছুক্ষণের জন্যে ভয় পাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে বলল, আপা, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
সুন্দর মানুষকে সুন্দর লাগবে এটা তো নতুন কিছু না। তোকে তেমন সুন্দর লাগছে না। ভয়ে চোখ-মুখ বসে গেছে। এত কিসের ভয়?
স্টেশন থেকে আমরা যাব কি ভাবে?
অন্যরা যে ভাবে যায় সেই ভাবে যাব। রিকশা পাওয়া গেলে রিকশায়, গরুর গাড়ি পাওয়া গেলে গরুর গাড়ি, নৌকায় যাবার ব্যবস্থা থাকলে নৌকায়। কিছু না পাওয়া গেলে হন্টন।
হেঁটে এত রাস্তা যেতে পারবে?
এত রাস্তা তুই কোথায় দেখলি? মাত্র সাত মাইল। এলিভেন পয়েন্ট টু কিলোমিটার। তিন ঘণ্টার মত লাগবে।
নীতুদের কামরায় লোকজন বেশি নেই। তাদের বেঞ্চটা পুরো খালি। একজন এসে বসেছিল, কিছুক্ষণ পর সেও সামনের বেঞ্চে চলে গেছে। নীতু এই ব্যাপারগুলি লক্ষ্য করছে–কোন্ স্টেশনে কজন উঠল, কজন নামল। সামনের বেঞ্চে এখন সাতজন মানুষ বসে আছে। সবাই পুরুষ। কোন মেয়ে এখন পর্যন্ত তাদের কামরায় উঠেনি। যারা এই কামরায় উঠেছে তারা সবাই বয়স্ক বুড়ো ধরনের গ্রামের মানুষ। শুধু একটি ন-দশ বছরের ছেলে আছে। ছেলেটা বোধহয় অসুস্থ। এই গরমেও তাকে কথা দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। ছেলেটির পাশে যে বুড়ো মানুষটি বসে আছে তার কোলে ঝকঝকে পেতলের একটা বদনা। সে বদনার নলটা কিছুক্ষণ পর পর ছেলেটার মুখে ধরছে। ছেলেটা চুক চুক করে কি যেন খাচ্ছে। কি আছে বদনায়–পানি? বদনায় করে কেউ পানি খায়?
নীতু ফিস ফিস করে বলল, আপা, বদনায় করে ঐ ছেলেটা কি খাচ্ছে?
শাহানা বলল, আমার তো জানার কথা না নীতু।
একটু জিজ্ঞেস করে দেখো না।
তোর জানতে ইচ্ছা করছে, তুই জিজ্ঞেস কর। আমাকে দিয়ে জিজ্ঞেস করাবি কেন?
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো বলে দিনের আলো নেই। এখন কামরার ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার। নীতুর ব্যাগে একটা পেনসিল টর্চ আছে। টর্চটা সে বের করবে কি-না বুঝতে পারছে না। নীতু বলল, ট্রেনের বাতি জ্বলছে না কেন আপা?
শাহানা কিছু বলার আগেই সামনের বেঞ্চ থেকে এই একজন বলল, এই লাইনের ট্রেইনে রাইতে বাত্তি জ্বলে না।
নীতু বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
গরমেন্টের ইচ্ছা। করনের কিছু নাই।
নীতু বলল, গভর্নমেন্ট শুধু শুধু বাতি বন্ধ করে রাখবে কেন?
শাহানা মনে মনে হাসল। নীতু গল্প করার মানুষ পেয়ে গেছে। এখন বক বক করে কথা বলে যাবে। এক মুহূর্তের জন্যেও থামবে না। শাহানা জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়েছে। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। পত পত শব্দ হচ্ছে। ট্রেনের ভেতরটা অন্ধকার, বাইরে দিনশেষের আলো। তার অদ্ভুত লাগছে। ট্রেনযাত্রীর সঙ্গে নীতুর কথাবার্তা শুনতেও ভাল লাগছে। কি বকবকানিই না এই মেয়ে শিখেছে!
আফনেরা দুইজনে যান কই?
আমরা যাচ্ছি সুখানপুকুর। আমাদের দাদার বাড়ি। ঠাকরোকোনা স্টেশনে। নামব। সেখান থেকে রিকশায়, কিংবা নৌকায় যাব। কিছু না পেলে হেঁটে যাব। ঠাকরোকোনা কখন পৌঁছব বলতে পারেন?
এক-দুই ঘণ্টা লাগবে।
ট্রেনের গতি বাড়ছে। শাহানার চুল বাধা। তার ইচ্ছা করছে চুল ছেড়ে দিতে। ট্রেনের জানালায় মাথা বের করা থাকবে, বাতাসে চুল উড়তে থাকবে পতাকার মত। পৃথিবীতে সবচে সুন্দর পতাকা হল তরুণীর মাথার উড়ন্ত চুল। শাহানা কি খোপ খুলে ফেলবে? নীতু ডাকল, আপা!
শাহানা মুখ না ফিরিয়েই বলল, কি?
এই লাইনে ট্রেনে প্রায়ই ডাকাতি হয়।
কে বলল? ঐ বুড়ো?
হুঁ। তারা তো এই ট্রেনেই যাতায়াত করে। সব জানে। ডাকাতরা আউট স্টেশনে ট্রেন থামায় তারপর ডাকাতি করে।
করুক। ডাকাতরা তো ডাকাতি করবেই। ডাকাতি হচ্ছে তাদের পেশা।
একটা কথা বললেই তুমি তার অন্য অর্থ কর। যদি ডাকাত পড়ে আমরা কি করব?
আগে ডাকাত পড়ুক তারপর দেখা যাবে। আউট স্টেশন আসতে দেরি আছে। তুই এত অস্থির হোস না তো নীতু, যা হবার হবে। আগে আগে এত চিন্তা করে লাভ কি? জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখ কি সুন্দর লাগছে।
নীতু নিতান্ত অনিচ্ছায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তার কাছে মোটেই সুন্দর লাগছে না, বরং ভয় আরও বেশি লাগছে। ঘন কালো আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের ঝাপ্টা চোখে-মুখে লাগছে। নীতু ফিস ফিস করে বলল, পেতলের বদনায় ছেলেটাকে কি খাওয়াচ্ছে জান আপা?
না।
তালতলার পীর সাহেবের পড়া পানি। এই পড়া পানি পেতলের পাত্রে রাখতে হয়। না রাখলে পানির গুণ নষ্ট হয়ে যায় ছেলেটার কামেলা রোগ হয়েছে। কামেলা রোগ কি আপা?
কামেলা হল জণ্ডিস।
পড়া পানি পেতলের পাত্রে রাখলে গুণ নষ্ট হয় না কেন আপা?
আমি জানি না। তালতলার পীর সাহেব হয়ত জানেন।
আপা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে…।
হুঁ। প্রচণ্ড ঝড় হবে, তাই না আপা?
ঝড় হবে কি-না বুঝতে পারছি না, তবে বৃষ্টি হবে।
আমার কাছে মনে হচ্ছে ঝড় হবে। আচ্ছা আপা, ঝড়ের সময় ট্রেন কি চলতে থাকে, না এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে?
জানি না।
আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
ট্রেন থেকে আমরা যখন নামব তখন ট্রেনের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস। তারই জানার কথা। জিজ্ঞেস করবি?
তুমি আমার হয়ে জিজ্ঞেস করে দেবে?
আমি করব না। তুই করবি। তোর কৌতূহল হয়েছে, তুই মেটাবি।
তোমার কোন কৌতূহল নেই?
শাহানা সহজ গলায় বলল, ঝড়ের সময় ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে, না চলতে থাকে। এটা জানার কোন কৌতূহল নেই। পৃথিবীতে জানার অনেক বিষয় আছে।
ট্রেনের কামরায় হারিকেন জ্বলছে। অসুস্থ ছেলেটির বাবা হারিকেন ধরিয়েছে। এরা রাতে ট্রেনে চাপলে হারিকেন সঙ্গে নিয়েই উঠে। হারিকেনটার কাচ ভাঙা। লাল শিখা দপদপ করছে। যে কোন মুহূর্তে নিভে যাবে। নীতু গভীর আগ্রহ নিয়ে হারিকেনের শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে পেনসিল টর্চ। টচটা কিচ্ছ করছে না। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। হালকা বর্ষণ। শাহানা মাথা বের করে ভিজছে।
ঠাকরোকোনা স্টেশন আসতে দেরি নেই। সামনের স্টেশনই ঠাকরোকোনা। ট্রেনের গতি এখনো কমতে শুরু করেনি। আউট স্টেশনের সিগন্যালের পর কমতে থাকবে। শাহানা হাতের ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল। রেডিয়াম ডায়ায় থাকা সত্ত্বেও ঘড়ির লেখা পড়া যাচ্ছে না। তবে রাত নটার মত বাজে। চর ঘণ্টা লেট। রাত নটা ঢাকা শহরে এমন কিছু রাত না–কিন্তু ঢাকার বাইরে গভীর রাত। শাহানা চিন্তিত বোধ করছে। এতক্ষণ সে সাহসী তরুণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে–ট্রেন থামার পর সত্যিকার অর্থেই সাহসী তরুণী হতে হবে। সুখানপুকুরে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে–দুটি মেয়ে ইচ্ছা করলে নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়াতে পারে। বডিগার্ডের মত একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে না থাকলেও হয়।
ভরা বৃষ্টির মধ্যে তারা স্টেশনে নামল। তাদের নামিয়ে দিয়েই ট্রেন হুস করে চলে গেল। নীতু বলল, আপা, আমরা দুজনই শুধু নেমেছি–আর কেউ না। এটা স্টেশন তো? নাকি পথে কোথাও নেমে পড়েছি?
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে বাতির আভাস দেখা যায়। ঐটাই কি স্টেশন মাস্টারের ঘর? শাহানা আলোর দিকে এগুচ্ছে, নীতু আসছে তার পেছনে পেছনে। দুজনের হাতে দুটা স্যুটকেস। নীতু রাজ্যের গল্পের বই তার স্যুটকেসে ভরেছে বলে অসম্ভব ভারী। তার রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। কষ্টের সঙ্গে আতংকও যুক্ত হয়েছে–তার এখনো ধারণা তারা স্টেশনে নামেনি। কোন কারণে ট্রেন স্টেশনের আগেই থেমেছিল। তারা নেমে পড়েছে। নয়তো একটা স্টেশনে মাত্র দুজন যাত্রী নামবে কেন?
আপা!
হুঁ।
ভিজে গেছি তো আপা।
বৃষ্টির ভেতর হাঁটলে তো ভিজতে হবেই। তুই ভরা বৃষ্টিতে হাঁটবি আর গা থাকবে শুকনা খটখটে তা হয় না।
আমরা এখন কি করব?
প্রথমেই স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বলব…।
তারপর?
তারপরেরটা তারপর।
নীতু আতংকিত গলায় বলল, আপা, আমি গোবরে পা দিয়ে ফেলেছি।
ভাল করেছিস।
শাহানা হাসছে। নীতুর প্রায় কান্না পেয়ে গেল। সে লক্ষ্য করছে, আজেবাজে ধরনের দুর্ঘটনা সব সময় তার কপালেই ঘটে। গোবরে শাহানার পাও পড়তে পারত। তা না পড়ে তার পা পড়ল কেন? সে কি দোষ করেছে?
ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে স্টেশন মাস্টার মনসুর আলি তাকিয়ে আছেন। তাঁর শরীর ভাল না। জ্বরে কাহিল হয়ে আছেন। এতক্ষণ চেয়ারে বসেই ঘুমুচ্ছিলেন। ট্রেন আসার শব্দে জেগে উঠেছেন। তাঁর চোখ-মুখ ভাবলেশহীন হলেও তিনি যে আকাশ থেকে পড়ছেন তা বোঝা যাচ্ছে। রাত-দুপুরে ফুটফুটে দুটি মেয়ে স্টেশনের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, এর মানে কি? একজনের বয়স বার-তের। অন্যজনের বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। উনিশ কুড়ি হতে পারে আবার চব্বিশ-পঁচিশও হতে পারে। দুটি মেয়েই পরীর মত। সঙ্গে কোন পুরুষমানুষ দেখা যাচ্ছে না। এরা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেনি তো? বাড়ি থেকে পালিয়ে এলে পুলিশে খবর দিতে হয়। বাড়তি ঝামেলা। ঝড় বৃষ্টির রাত–কোথায় বাড়িতে গিয়ে আরাম করে ঘুমুবেন তা না, থানা পুলিশ ছুটাছুটি কর।
নীতু স্টেশন মাস্টারের দিকে অকিয়ে বলল, আপনাদের স্টেশনে টিউবওয়েল আছে? আমি পা ধোব। ভুলে আমি গোবরে পা দিয়ে ফেলেছি। স্টেশন ভর্তি এত গোবর কেন?
স্টেশন মাস্টার মনসুর আলির গলার স্বর এম্নিতেই ভাঙা। সেই স্বর আরো ভেঙে গেল। তিনি গোবর সমস্যার ধার দিয়ে গেলেন না। আগে মূল সমস্যাটা ধরতে হবে। তারপর গোবর। তিনি নীতুকে এড়িয়ে শাহানার দিকে তাকিয়ে বললেন–কোথায় যাওয়া হবে?
আপনি-তুমির সমস্যা এড়িয়ে ভাববাচ্যে কথা বলা। তার রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে গেছে। এই বয়সে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের আপনি বলতে ইচ্ছা করে না। আবার চট করে তুমিও বলা যায় না।
শাহানা বলল, আমরা সুখানপুকুর যাব। আপনি কি দয়া করে আমার ছোটবোনের পা ধোয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন? ওর শুচিবায়ুর মত আছে।
সুখানপুকুর কার কাছে যাওয়া হবে?
শাহানা হাসি হাসি মুখে বলল, সুখানপুকুরে আমাদের দাদার বাড়ি। দাদাকে দেখতে যাব।
আপনার দাদার নাম কি ইরতাজুদ্দিন?
জি।
ও, আচ্ছা আচ্ছা। আপনারা আসুন, ভেতরে এসে বসুন। আচ্ছা দাঁড়ান, তার আগে পা ধোয়ার ব্যবস্থা করি।
মনসুর আলি নিজের চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। নীতু ফিস ফিস করে বলল–বিখ্যাত দাদা থাকার অনেক সুবিধা, তাই না আপা?
হুঁ। এখন আর আমাদের কোন অসুবিধা হবে না।
মনে হয় না।
এই ভরসাতেই তুমি এত নিশ্চিত হয়েছিলে?
শাহানা হাসল।
মনসুর আলি সাহেবের মুখে কোন হসি নেই। রাত বারটা একুশ মিনিটে নাইন আপ পার করে দেবার পর ভোর নটা পর্যন্ত তার নিশ্চিন্ত থাকার কথা ছিল। সুন্দর বৃষ্টি নেমেছে। আরামের ঘুম ঘুমানো যাবে। এখন মনে হচ্ছে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। পয়েন্টসম্যান বদরুলকে খুঁজে বের করতে হবে। কোথাও নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। মেয়ে দুটির সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আছে নিশ্চয়ই। ভং ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে। সামান্য স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বললে তাদের অপমান হবে। এদের চা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। বদরুলকে পাঠিয়ে চা আনাতে হবে। এরা এইসব চা খাবে না। এক চুমুক দিয়ে রেখে দেবে। তারপরও দিতে হবে। সুখানপুকুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কাঁচা রাস্তা। হাঁটু পর্যন্ত ডেবে যাবে কাদায়। গরু গাড়ি পাওয়া গেলে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়া যাবে। এত রাতে পাওয়া যাবে কি না কে জানে।
মনসুর আলি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন মেয়ে দুটির সঙ্গে পুরুষমানুষ কেউ আসেনি। এরা একাই এসেছে। সারা স্টেশন খুঁজে বদরুলকে পেলেন না। হারামজাদা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফাজিলদের একজন। বাড়িতে গিয়ে ঘুমুচ্ছে। চায়ের খোঁজে তাকেই যেতে হবে। তার হঠাৎ মনে হল, তিনি সঙ্গে ছাতা আনেননি। এম্নিতেই গায়ে জ্বর। তার উপর বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাৎ বুকে ঠাণ্ডা বসে যাবে। জ্বর আরো বাড়বে, ধরবে নিওমোনিয়া।
নীতু বলল, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
মনসুর আলি বললেন, না না, ব্যস্ত হচ্ছি না তো। ব্যস্ত হবার কি আছে? আপনারা চা খাবেন?
নীতু বলল, পরে খাব। আগে পা খোব। এখানে টিউবওয়েল আছে না?
ও আচ্ছা হ্যাঁ–পা। অবশ্যই। অবশ্যই। টিউবওয়েল আছে। টিউবওয়েল থাকবে না কেন?