Himu Mama Pdf Download – হিমু মামা

5/5 - (2 votes)

হিমু মামা – হুমায়ূন আহমেদ

হিমু মামা বাংলাদেশী লেখক হুমায়ূন আহমেদের হিমু সিরিজের উপন্যাস যা ২০০৪ সালে ‘অবসর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়।তাই দেরি না করে নিচের ডাউনলোড বাটনটিতে ক্লিক করে পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করে পড়া শুরু করে দিন।

হিমু মামা উপন্যাসের প্রথম কিছু অংশ

টগরদের বাড়িতে আজ সন্ধ্যায় ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে।
একজনকে ‘ছেঁচা’ দেয়া হবে। সেই একজন ভয়ঙ্কর একটা অপরাধ করেছে। এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ যে বাড়ির সবার মুখ গম্ভীর। ছেঁচা দেয়ার আয়োজন সকাল থেকেই চলছে। আনুষ্ঠানিক শাস্তি তো, আয়োজন লাগে। ছেচা দেবেন টগরের বড় চাচা, চৌধুরী আজমল হোসেন।
চৌধুরী আজমল হোসেন ছোটখাটো মানুষ। একসময় হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। এখন করেন না। বছর খানেক আগেও তার মাথাভর্তি সাদা চুল ছিল। এখন সব পড়ে গেছে। টগরের খুব ইচ্ছা করে তাকে টাকালু চাচা ডাকতে। সেটা সম্ভব না। চৌধুরী আজমল হোসেন সব সময় হাসি হাসি মুখ করে থাকেন। নিচু গলায় কথা বলেন। তাকে দেখে মনে হয় তিনি বেশ আনন্দে আছেন। তারপরও সবাই তাকে ভয় পায়। টগরের ধারণা, এ বাড়ির আসবাবপত্রও তাকে ভয় পায়। যে ইজিচেয়ারে তিনি বেশির ভাগ সময় শুয়ে থাকেন (মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়েন)। সেই ইজিচেয়ার তাকে ভয় পায়। যে বইটা তিনি পড়েন সেই বইটাও ভয় পায়। ইজিচেয়ারে শোয়ার সময় যে টুলে তিনি পা তুলে রাখেন সেই টুলও তাঁকে ভয় পায়।
চৌধুরী আজমল হোসেন এ বাড়ির প্রধান বিচারক। টগরদের বাড়ির যে কোনো অন্যায়ের বিচার তিনি করে থাকেন। তার কথার ওপর কথা বলার সাহস কারোরই নেই। শুধু একজনের আছে, তিনি টগরের দাদিয়া। তবে তার খুব শরীর খারাপ বলে তিনি বেশির ভাগ সময় বিছানায় শুয়ে থাকেন। কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। কেউ তাঁর ঘরে ঢুকলে তিনি কড়া গলায় বলেন, এ চায় কী? এই ছাগলা কী চায়? এ আমার ঘরে ঢুকছে কী জন্য? আমার ঘরে কি সোনার খনি আছে?
আজ যাকে ছেঁচা দেয়া হবে সে টগরের ছোট মামা। তার নাম শুভ্ৰ। খুবই ভালো ছাত্র। এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। ফার্স্ট-সেকেন্ড কিছু একটা হবে। অবশ্যই হবে। কিছু ছেলেমেয়ে আছে যারা পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড না হয়ে থাকতে পারে না। পরীক্ষা দিলেই হয়। ফার্স্ট না হয়। সেকেন্ড শুভ্ৰ হলো সে রকম। সে এসএসসি পরীক্ষাতে ঢাকা বোর্ডে ফার্স্ট হয়েছিল। সব পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছে। চোখ ট্যারা এক ছেলে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে, এ রকম ছবি। শুভ্র ট্যারা না। তবে ছবি তোলার সময় সে কিছু একটা করে দুটা চোখের মণি একসঙ্গে নিয়ে আসে। ছবি ডেভেলপ করলে দেখা যায় সে ট্যারা। শুভ্ৰ যে পরীক্ষা দিলেই ফার্স্ট-সেকেন্ড হয় এই প্রতিভায় টগর মুগ্ধ না। সে মুগ্ধ ছোট মামার ট্যারা হবার ক্ষমতা দেখে।
যে ভয়ঙ্কর অপরাধের কারণে শুভ্ৰকে আজ সন্ধ্যায় শাস্তি দেয়া হবে তা হলো, গত বুধবার সকাল এগারোটায় হলুদ পাঞ্জাবি পরে সে হিমু হয়ে গেছে। টগরকে ডেকে বলেছে এখন থেকে আমাকে ছোট মামা ডাকবি না। হিমু মামা ডাকবি।
হিমু হওয়া ব্যাপারটা ঠিক কী টগর জানে না।

Humayun Ahmed Quotes


এইটুকু শুধু জানে, যারা হিমু হয় তাদের খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। কটকট হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরতে হয় এবং বেশির ভাগ সময় জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলতে হয়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মিষ্টি করে হাসতে হয়।
হিমু হওয়া এমন কোনো বড় অপরাধ বলে টগরের মনে হচ্ছে না। তবে বড়দের কাছে নিশ্চয়ই বিশাল অপরাধ। তা না হলে এমন আয়োজন করে বিচারসভা বসবে না। বড় চাচা নিজে এসে বলে গেছেন, শুভ্ৰ! তুমি আজ ঘর থেকে বের হবে না। সন্ধ্যার পর তোমার সঙ্গে কথা আছে।
টগরের ছোট মামা বলল, কী কথা, এখন বলুন।
বড় চাচা বললেন, কথা সবার সামনে হবে। সবাইকে সন্ধ্যার পর থাকতে বলেছি।
আমি কি কোনো অন্যায় করেছি?
ন্যায় করেছ নাকি অন্যায় করেছ সেই বিবেচনাও তখন হবে। ন্যায়-অন্যায় একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। তোমার কাছে যা ন্যায় অন্যের কাছেই হয়তো তা অন্যায়।
শুভ্ৰ গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে, সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত আমি যেখানে বসে আছি সেখানে বসে থাকব। নড়াচড়া করব না। সন্ধ্যা হবার পর আমাকে ডেকে নেবেন।
চৌধুরী আজমল হোসেন বললেন, তোমাকে এখানে বসে থাকতে হবে না। তোমার যেখানে ইচ্ছা তুমি সেখানে যেতে পার। শুধু সন্ধ্যাবেলা আমার ঘরে চলে আসবে। তোমার যা বলার তখন শুনব।
শুভ্র বসে আছে তার ঘরের বেতের চেয়ারে। তার বসার ভঙ্গির মধ্যে মূর্তি-মূর্তি ভাব। টগর জানে তার ছোট মামা এই যে বসে আছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত বসেই থাকবে। হিমুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকার কাজ খুব ভালো পারে। এটা তাদের পারতে হয়।

Himu rupa


শুভ্রের ঘর আগে অনেক সাজানো-গোছানো ছিল। খাটে ফোমের বিছানা ছিল। বিছানায় যশোরের সূচের কাজ করা নীল চাদর ছিল। টিভি ছিল, ভিসিডি প্লেয়ার ছিল, গান শোনার জন্য মিউজিক সিষ্টেম ছিল। এখন কিছুই নেই। খাটের ওপর মাদুর বিছানো। মাদুরের নিচে তোশক পর্যন্ত নেই। বালিশও নেই। কারণ হিমুরা আয়েশ করে ফোমের বিছানায় ঘুমোবে না। নিয়ম নেই। তারা যেখানে—সেখানে ঘুমিয়ে পড়বে। মাথার নিচে বালিশ থাকবে না। প্রয়োজনে তারা থান ইটের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমোবে। শুভ্ৰ অবিশ্যি মাথার নিচে থান ইট দেয় না, বড় একটা ডিকশনারি দেয়। ডিকশনারির নাম বঙ্গীয় শব্দকোষ।
টগর তার মামার খুবই ভক্ত। অনেক কিছু সে তার মামার কাছে শিখেছে। কিছুদিন আগে শিখল পাঁচ নম্বরি ফুটবলের সাইজ বুদ্বুদ বানানো। জায়ান্ট সাইজ বাবল বানানোর নিয়ম হলো—আধ বালতি পানিতে তিন কাপ ডিসওয়াশিং লিকুইড সাবান মেশাতে হবে, তরকারির চামচে এক চামচ গ্লিসারিন মেশাতে হবে। তারপর চার-পাঁচ টুকরা বরফ মিশিয়ে পানিটা ঠাণ্ডা করতে হবে। এখন কাগজের নল বানিয়ে সেই নল পানিতে চুবিয়ে ফুঁ দিলেই বিশাল বড় বড় বুদ্বুদ হবে। এই বুদ্বুদ ফট করে মরে যাবে না। অনেকক্ষণ ঘরের বাতাসে ঘুরঘুর করবে।
শুভ্ৰ বুদ্বুদ বানানো ছাড়াও এখন টগরকে শেখাচ্ছে কী করে ছবি তোলার সময় ট্যারা হওয়া যায়। জিনিসটা বেশ কঠিন। কপালের শিরায় হ্যাঁচকা টানের মতো দিতে হয়। তারপর তাকিয়ে থাকতে হয় নাকের ডগার দিকে। টগর এখনো শিখে উঠতে পারেনি। তার সময় লাগছে।
টগর, ছোট মামার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মামাকে সে অত্যন্ত পছন্দ করে বলেই তার খুব খারাপ লাগছে। কেউ হিমু হলেই তার জন্য বিচারসভা বসাতে হবে? হিমু হওয়া কি খারাপ? হিমুরা তো কিছু করে না, শুধু হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘোরে।
শুভ্র বলল, কিছু বলবি?
টগর বলল, চা খাবে মামা? বুয়াকে বলে তোমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসি? কড়া করে। চিনি বেশি দিয়ে।
শুভ্র বলল, চা-ফা লাগবে না। হিমুদের এত আয়েশ করে চা খাওয়ার নিয়ম নেই।
হিমুরা চা খায় না?
খায়। রিকশাওয়ালা বা ঠেলাওয়ালাদের সঙ্গে খায়। অ্যারেস্ট হলে থানার ওসি বা কনষ্টেবলের সঙ্গে খায়।
হিমুরা অ্যারেস্ট হয়?
বলিস কী, অ্যারেক্ট হবে না? হিমুদের জীবনের একটা অংশ কাটে জেল— হাজতে। পুলিশের গুতা, বুটজুতার লাগি তাদের নিত্যসঙ্গী। কোনো অপমানই তাদের গায়ে লাগে না।
টগর, ইতস্তত করে বলল, এখন কি তোমার ভয় লাগছে, মামা?
শুভ্র বলল, ভয় লাগবে কেন?
টগর বলল, এই যে আজ সন্ধ্যায় তোমার বিচার হবে, এই জন্য? তোমাকে হয়তো এ বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
শুভ্ৰ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দিক বের করে। সব ঠাই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর ফিরি খুঁজিয়া। হিমুরা পৃথিবীর কোনো কিছুকে ভয় পায় না। হিমুদের প্রথম যে জিনিসটা জয় করতে হয় তার নাম হলো ভয়।
তুমি ভয় জয় করেছ?
সব ভয় এখনো জয় করতে পারিনি। যেমন ধরা উড়ন্ত তেলাপোকা এখনো ভয় পাই। অন্ধকার ঘরে ঘুমাতে পারি না। বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এই দুটা ছাড়া বাকি ভয় মোটামুটি জয় করে ফেলেছি। তুই এখন আমার সামনে থেকে যা তো!
যাব কেন?
তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। অকারণে কথা বলাও হিমুদের জন্য নিষিদ্ধ। সামনে থেকে যা। তবে এক কাপ চা এনে দিতে পারিস। তোর কাছ থেকে চায়ের কথা শোনার পর থেকে চা খেতে ইচ্ছা করছে। হিমুদের উচিত খাদ্যবিষয়ক সমস্ত লোভ জয় করা। এখনো পারছি না।
টগর বলল, তুমি যে এতক্ষণ ধরে এক জায়গায় বসে আছ, তোমার খারাপ লাগছে না?
শুভ্র বলল, খারাপ লাগার ব্যাপারটাই হিমুদের মধ্যে নেই। কোনো কিছুতেই তাদের খারাপ লাগে না। প্রচণ্ড শীতে তারা খালি গায়ে বরফের চাঙের ওপর শুয়ে থাকতে পারে। আবার কম্বল গায়ে দিয়ে চৈত্র মাসের রোদে হাঁটাহাটি করতে পারে। ঠাণ্ডা-গরম হিমুদের কাছে কোনো ব্যাপার না। হিমুরা শারীরিক বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
টগর বলল, মামা, আমাকে কবে হিমু বানাবে?
শুভ্ৰ বিরক্ত গলায় বলল, তোর এখনো অনেক সময় লাগবে। সামান্য ট্যারা হওয়া শিখতে পারলি না। হিমু হবি কীভাবে? যা চা নিয়ে আয়।
টগর রান্নাঘরের দিকে গেল। টগরের মা সুলতানা মুরগির মাংস নিয়ে কী যেন করছেন। দুজন কাজের বুয়া তাকে সাহায্য করছে। সুলতানাকে খুবই হাসিখুশি দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই নতুন ধরনের কিছু রান্না করছেন। নতুন ধরনের রান্নাবান্না করার সময় তাকে খুবই হাসিখুশি দেখায়। তার জীবনের শখ তিনি একটা রেস্টুরেন্ট দেবেন। রেস্টুরেন্টের নাম উনুন। সেই রেস্টুরেন্টে স্পেশাল আইটেম ছাড়া অন্য কোনো আইটেম থাকবে না।
সুলতানা স্পেশাল আইটেম রান্না খুব পছন্দ করেন। প্রায়ই তিনি স্পেশাল কিছু না কিছু বানাচ্ছেন। বেশির ভাগ সময়ই জিনিসটা হয়- অদ্ভুত এবং খেতে বিস্বাদ। টগরের বাবা চৌধুরী আলতাফ হোসেন এমনিতে খুব হাসিখুশি মানুষ। একেবারেই রাগেন না। শুধু সুলতানা নতুন কিছু রান্না করেছেন শুনলে চট করে রেগে যান। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া যা হয় নতুন রান্না নিয়ে হয়। যেমন টগরের বাবা কোনো একটা খাবার মুখে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, এটা কী? এই বস্তুটার নাম কী?
সুলতানা হাসিমুখে বললেন, ডেজার্ট। আপেল দিয়ে কানানো ডেজার্ট। আমেরিকানরা বলে, অ্যাপল টার্ট।
ডেজার্ট তাহলে ঝাল কেন?

Himu Series এর সকল বই ডাউনলোড করুন


সামান্য গোলমরিচ দিয়েছি, এই জন্য বোধ হয় ঝাল হয়েছে। এরকম রাণী রাগী চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? খেতে ইচ্ছা না হলে খেও না।
মিষ্টি জাতীয় একটা খাবার রান্না করছ, এর মধ্যে ঝাল কেন? ঝাল দিয়ে কেউ মিষ্টি রান্না করে?
চিৎকার করছ কেন? বললাম তো খেতে ইচ্ছা না হলে খাবে না। তোমাকে তো আমি সাধাসাধি করছি না।
ঝাল রসগোল্লা, মিষ্টি গরুর মাংসের কালিয়া এইসব বন্ধ করে নরমাল কোনো রান্না রাঁধতে পার না? সাধারণ ভাত-মাছ, আলুভর্তা, ডাল।
সাধারণ খাবার তো রোজই হচ্ছে। দু-একটা স্পেশাল রান্না হবে না?
না, হবে না। আবার যদি স্পেশাল কিছু রান্না করো, আমি অবশ্যই বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাব।
একেবারে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ, চলে যেতে হবে। বনে-জঙ্গলে থাকব। ঘাস-লতা-পাতা খাব। তোমার টার্ট-ফার্ট খেতে পারব না।
রান্না নিয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে টগর অভ্যস্ত। এই ঝগড়া দেখতে তার ভালো লাগে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে সে সব সময় বাবার পক্ষ নেয়। যদিও ছোট ছেলেদের উচিত মায়ের পক্ষ নেয়া। ছেলেরা নেবে মায়ের পক্ষ, মেয়েরা নেবে বাবার পক্ষ । এটাই নিয়ম। টেগরের নিয়ম মানতে ভালো লাগে না। আশপাশে যত বেশি অনিয়ম হয় টগরের ততই ভালো লাগে।
রান্নাঘরে মায়ের আনন্দিত মুখ দেখে টেগরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে এত বড় বিচারসভা বসবে অথচ কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। মা কেমন হাসাহাসি করতে করতে মুরগির মাংস ছানাছানি করছেন। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু বানাচ্ছেন।
সুলতানা টগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, রান্নাঘরে ঘুরঘুর করিস না তো! ছেলেপুলেকে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করতে দেখলে আমার খুবই বিরক্তি লাগে। ঘণ্টাখানেক পরে আয়, মুরগির মাংসের মিষ্টি কাবাব খাইয়ে দেব। নতুন রেসিপি। কাশ্মিরে এইভাবে মুরগির মাংস রান্না হয়।
টগর, বলল, আমি মিষ্টি কাবাব খাব না।
খাবি না কেন, অবশ্যই খাবি। রসমালাই দেখলে হামলে পড়িস, মুরগির মিষ্টি কাবাব খেতে পারবি না? বাবার স্বভাব দেখি পুরোটা পেয়েছিস। সামনে থেকে যা, ঘুরঘুর করিস না।
আমি ঘুরঘুর করছি না, কাজে এসেছি।
কী কাজ?
ছোট মামা চা খাবে। চা দাও।
সুলতানা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ফাজিলটার নাম মুখে আনবি না। ওকে চা খাওয়াতে হবে না। ওর হিমুগিরি আগে বের হোক, তারপর চা। গা থেকে হলুদ পাঞ্জাবি খুলে কানে ধরে দশবার উঠবোস করবে তারপর ফরমাশ দিবে।
হিমু হওয়া তো দোষের কিছু না, মা।
দোষের না গুণের তা নিয়ে তোর সঙ্গে তর্ক করতে পারব না। দুই আঙুল ছেলে, আমার সঙ্গে তর্ক করতে এসেছে। যা সামনে থেকে।
টগর অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, এমন করছ, কেন মা? দাও না এক কাপ চা বানিয়ে। চিনি—দুধ বেশি।
সুলতানা কঠিন গলায় বললেন, সামনে থেকে যাবি নাকি মুরগিমাখা হাতে একটা থাপ্পড় খাবি?
টগর রান্নাঘরের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। ছোট মামা বেচারা চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে, অথচ তাকে সে চা দিতে পারছে না। খুবই খারাপ ব্যাপার। টগর দ্রুত চিন্তা করছে কোনো একটা বুদ্ধি বের করা যায় কি না। তার মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসছে না। যখন কোনো বুদ্ধির দরকার হয় না। তখন মাথায় নানা রকম বুদ্ধি আসে আর যখন প্রয়োজন হয় তখন কোনো বুদ্ধিই আসে না।
টগর, ছোট মামার ঘরে চলে এল। মামা ঠিক আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে, তবে চোখ বন্ধ। সে চোখ না খুলেই বলল, আমার চা কই?
টগর। এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবারো ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার কাছে মনে হলো সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত সে এই কাজই করবে। একবার নিজের ঘরে ঢুকবে। ছোট মামা বলবেন, চা কই? সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। আবার ঢুকবে। আবার বের হবে। আবার ঢুকবে। আবার বের হবে। আসা-যাওয়া চলতেই থাকবে।
ছোট মামার ঘর থেকে বের হয়ে একসময় কী মনে করে যেন টগর দাদিয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। টগরের দাদিয়া তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, এ চায় কী? এই ছাগলা কী চায়? আমার ঘরে ঢুকছে কী জন্য? আমার ঘরে কি সোনার খনি আছে?
টগর বলল, দাদিয়া, আমি টগর। আমি তোমার ঘরে ঢুকিনি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
তুই আমার দরজার সামনে দিয়া একবার যাস একবার আসস। তুই তাঁতের মাকু হইছস? তোর ঘটনা কী?
কোনো ঘটনা নাই।
কেউ তোরে বকা দিছে? তুই কি আমারে নালিশ করতে চাস?
না।
বকা দিলে আমারে তার নাম কি। আমি ব্যবস্থা নিব। আমি যতদিন বাঁইচ্যা আছি ছোট পুলাপানের ওপরে বকা চলাব না। কে তোরে বকছে? তোর মা? ডাক দেখি তোর মারে।
মা বকে নাই।
তাইলে বকছে কে? তোর বড় চাচা? হে মাথা ছিলা বান্দর হইয়া বকা মাষ্টর সাজছে? যারে তারে-হ্যামকি ধমকি? ডাক তারে।
দাদিয়া আমাকে কেউ বকে নাই।
না বকলে সামনে থাইক্যা যা। ত্যক্ত করিস না।
টগর দাদিয়ার ঘরের সামনে থেকে চলে এল। আর তখনি তার ভেতর থেকে দুঃখ দুঃখ ভাবটা পুরোপুরি চলে গেল। কারণ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। কীভাবে ছোট মামার জন্য এক কাপ চা জোগাড় করা যায় সেই বুদ্ধি। দাদিয়ার সঙ্গে কথা না বললে মাথায় এই বুদ্ধি আসত না। ভাগ্যিস সে কথা বলেছিল।
টগর রান্নাঘরে মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, মা, চুলা কি বন্ধ?
সুলতানা বললেন, চুলা বন্ধ না খোলা এটা দিয়ে তোর কী দরকার? শুধু শুধু বিরক্ত করা।
টগর, বলল, শুধু শুধু বিরক্ত করছি না। দাদিয়া চা খেতে চাচ্ছেন।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, বলিস কী, ওনার কি শরীর ঠিক হয়েছে নাকি?
টগর বলল, শরীর ঠিক হয়েছে কি হয়নি। আমি জানি না। দাদিয়ার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, দাদিয়া বললেন, টগর, এক্ষুনি তোর মাকে গিয়ে বল আমাকে কড়া করে এক কাপ চা দিতে। চিনি বেশি।
চিনি বেশি কী জন্য? ওনার ডায়াবেটিস। উনি তো চায়ে চিনিই খান না।
আমাকে যেটা বললেন, আমি সেটা তোমাকে বললাম। হয়তো অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর দাদিয়ার চিনি খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি এক্ষুনি চা বানিয়ে আমার হাতে দাও। দাদিয়া আমাকে চা নিয়ে যেতে বলেছেন। অন্য কেউ নিয়ে গেলে চলবে না। উনি রাগ করবেন।
রাগ করবেন কেন?
রাগ করবেন। কারণ অসুখ থেকে ওঠার পর থেকে বড়দের কারোর মুখ দেখতে দাদিয়ার ইচ্ছা করছে না। শুধু ছোটদের মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে। বড়দের মুখ দেখলেই রাগ লাগছে।
দাঁড়া, চা নিয়ে যা।
টগর জানে তার নামে দুটো পাপ লেখা হয়ে গেছে। মিথ্যা কথা বললে এমনিতেই পাপ হয়। সেই মিথ্যা মায়ের সঙ্গে বললে পাপ ডাবল হয়ে যায়। তবে এই পাপ কাটানোর বুদ্ধি টগরের আছে। এখন কোনো একটা ভালো কাজ করতে হবে। পাপ এবং পুণ্যতে যেন কাটাকাটি হয়ে যায়।
ভালো কাজ কী করবে তা সে ঠিক করে ফেলেছে। তার বড় বোন নীলুর টেবিল থেকে তার অঙ্ক বইটা চুরি করে কোথাও লুকিয়ে রাখবে। আগামীকাল নীলুর অঙ্ক পরীক্ষা। বই খুঁজে না পেয়ে সে অস্থির হয়ে পড়বে। একসময় কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন সে বইটা বের করে নীলুকে দেবে। এটা একটা ভালো কাজ। এই ভালো কাজে আর আগের মন্দ কাজে কাটাকাটি হয়ে যাবে। মাইনাস ওয়ান প্লাস ওয়ান সমান সমান জিরো।
শুভ্ৰ চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, টগর, চা-টা ভালো হয়েছে।
বাসার চা কখনো ভালো হয় না। আশ্চর্যজনকভাবে এটা হয়েছে।
থ্যাঙ্কস! টগর বলল, ছোট মামা, তোমাকে আজ কী শাস্তি দেবে তুমি জানো?
না।
আমার মনে হয় বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
তা দেবে না। তবে আমি নিজেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।
কেন?
হিমুরা এক বাড়িতে বেশি দিন থাকতে পারে না। তাদের পথে পথে বেশি ঘুরতে হয়। জোছনা হলে বনে-জঙ্গলে গিয়ে জোছনা দেখতে হয়। বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়।
তাতে কী লাভ?
গাধার মতো কথা বলিস না তো টগর। মানুষ হয়ে জন্মেছিস মানুষের মতো কথা বলবি। হিমুরা কি লাভ-লোকসান হিসাব করে চলে? তারা কি বিজনেসম্যান? ব্রিফকেস হাতে নিয়ে ঘুরবে। কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে তেলতোলে মুখে হাসবে। যা আরেক কাপ চা নিয়ে আয়। এবারেরটাও যেন আগের মতো হয়।
আর চা না খেলে হয় না? বেশি চা খাওয়া তো ভালো না।
তোকে জ্ঞানীর মতো কথা বলতে হবে না। তোকে চা নিয়ে আসতে বলেছি নিয়ে আয়। চা খেতে খেতে একটা রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করব।
কী রহস্য?
আমি যে হিমু হয়ে গেছি, এটা তোর বড় চাচা কীভাবে জানল?
টগর বলল, এই বাড়িতে ওনার অনেক স্পাই আছে। বাড়ি গিজগিজ করছে স্পাইয়ে।
শুভ্র বলল, তাই তো দেখছি। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা চা নিয়ে আয়।
টগর অনাগ্রহের সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার কেন জানি মনে হচ্ছে দ্বিতীয়বার চা চাইতে গেলেই সব ধরা পড়ে যাবে। টগরের বুক টিপটিপ করছে। এর মধ্যে নীলু আবার অতিরিক্ত রকমের হৈচৈ শুরু করেছে, আমার অঙ্ক বই, আমার অঙ্ক বই। বাড়ি মাথায় তোলার মতো চিৎকার। টগরের খুবই বিরক্তি লাগছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেই কি বই পাওয়া যাবে! যখন সময় হবে বই আপনা-আপনি চলে আসবে।
নীলুর চিৎকার শুনে বড় চাচা বের হয়ে এসেছেন। তিনি নীলুকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না। বড় চাচার যে বুদ্ধি তিনি নীলুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললে বুঝে ফেলতে পারেন, অঙ্ক বই পাওয়া যাচ্ছে না। কেন। কাজেই এখন যেটা করতে হবে তা হলো, অঙ্ক বইটা এনে আগের জায়গায় রেখে দিতে হবে। বেশি দেরি করা যাবে না। টগর তা-ই করল। যেখানকার বই সেখানে।
টগর অঙ্ক বই নীলুর পড়ার টেবিলে রেখে বড় চাচার ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার উদ্দেশ্য বড় চাচার সঙ্গে নীলুর কথাবার্তা যদি কিছু শোনা যায়। আড়াল থেকে অন্যের কথা শোনা খুবই অন্যায়। বিরাট পাপ হয়। এই কাজটা টগরের করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আড়াল থেকে কথা শোনার পাপ কাটান দেয়ার জন্য ছোটখাটো কোনো পুণ্য করতে হবে। পাপ করলেই পুণ্য করে সব সমান সমান রাখা। সে বড় চাচার ঘরের দরজার ওপাশে দাঁড়াল।
নীলু ফোঁপাচ্ছে। ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। বড় চাচা বললেন, ফোঁপানি বন্ধ করা নীলু। বই পাওয়া যাচ্ছে না, এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার না যে তার জন্য ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। রাজ্য ছেড়ে রাজা বনবাসী হলেও কোনো রানী এভাবে কাঁদে না।
নীলু ফোঁপানি বন্ধ করল।
কী বই পাওয়া যাচ্ছে না?
অঙ্ক বই। আমি অঙ্ক করছিলাম। মাঝখানে দশ মিনিটের জন্য বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে গিয়েছি। ফিরে এসে দেখি বই নেই।
বই হাওয়া হয়ে গেছে?
হুঁ।
তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
না।
বই খুঁজে না পাওয়ার ঘটনা তো তোমার ক্ষেত্রে আগেও ঘটেছে। কিছুদিন পর পরই তো শুনি তোমার এই বই পাওয়া যাচ্ছে না, ওই বই পাওয়া যাচ্ছে না।
জি।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর যখন সবাই হাল ছেড়ে দেয়। তখন আবার বই খুঁজে পাওয়া যায়।
জি।
রহস্যটা কী?

বাকিটুকু পরতে পিডিএফ ডাউনলোড করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *