Somoyhara সময়হারা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Rabindranath Tagor

Rate this Book

সময়হারা
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

খবর এল , সময় আমার গেছে ,
আমার-গড়া পুতুল যারা বেচে
বর্তমানে এমনতরো পসারী নেই ;
সাবেক কালের দালানঘরের পিছন কোণেই
ক্রমে ক্রমে
উঠছে জমে জমে
আমার হাতের খেলনাগুলো ,
টানছে ধুলো ।
হাল আমলের ছাড়পত্রহীন
অকিঞ্চনটা লুকিয়ে কাটায় জোড়াতাড়ার দিন ।
ভাঙা দেয়াল ঢেকে একটা ছেঁড়া পর্দা টাঙাই ;
ইচ্ছে করে , পৌষমাসের হাওয়ার তোড়টা ভাঙাই ;
ঘুমোই যখন ফড়্‌ফড়িয়ে বেড়ায় সেটা উড়ে ,
নিতান্ত ভুতুড়ে ।
আধপেটা খাই শালুক-পোড়া ; একলা কঠিন ভুঁয়ে
চেটাই পেতে শুয়ে
ঘুম হারিয়ে ক্ষণে ক্ষণে
আউড়ে চলি শুধু আপন-মনে —
“ উড়কি ধানের মুড়কি দেব , বিন্নে ধানের খই ,
সরু ধানের চিঁড়ে দেব , কাগমারে দই । ”
আমার চেয়ে কম-ঘুমন্ত নিশাচরের দল
খোঁজ নিয়ে যায় ঘরে এসে , হায় সে কী নিষ্ফল ।
কখনো বা হিসেব ভুলে আগে মাতাল চোর ,
শূন্য ঘরের পানে চেয়ে বলে , “ সাঙাত মোর ,
আছে ঘরে ভদ্র ভাষায় বলে যাকে দাওয়াই ?”
নেই কিছু তো , দু-এক ছিলিম তামাক সেজে খাওয়াই ।
একটু যখন আসে ঘুমের ঘোর
সুড়সুড়ি দেয় আরসুলারা পায়ের তলায় মোর ।
দুপুরবেলায় বেকার থাকি অন্যমনা ;
গিরগিটি আর কাঠবিড়ালির আনাগোনা
সেই দালানের বাহির ঝোপে ;
থামের মাথায় খোপে খোপে
পায়রাগুলোর সারাটা দিন বকম্‌-বকম্‌ ।
আঙিনাটার ভাঙা পাঁচিল , ফাটলে তার রকম-রকম
লতাগুল্ম পড়ছে ঝুলে ,
হলদে সাদা বেগনি ফুলে
আকাশ-পানে দিচ্ছে উঁকি ।
ছাতিমগাছের মরা শাখা পড়ছে ঝুঁকি
শঙ্খমণির খালে ,
মাছরাঙারা দুপুরবেলায় তন্দ্রানিঝুম কালে
তাকিয়ে থাকে গভীর জলের রহস্যভেদরত
বিজ্ঞানীদের মতো ।
পানাপুকুর , ভাঙনধরা ঘাট ,
অফলা এক চালতাগাছের চলে ছায়ার নাট ।
চক্ষু বুজে ছবি দেখি — কাৎলা ভেসেছে ,
বড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে ।
ঝাউগুঁড়িটার’পরে
কাঠঠোকরা ঠক্‌ঠকিয়ে কেবল প্রশ্ন করে ।
আগে কানে পৌঁছত না ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ,
এখন যখন পোড়ো বাড়ি দাঁড়িয়ে হতবাক্‌
ঝিল্লিরবের তানপুরা-তান স্তব্ধতা-সংগীতে
লেগেই আছে একঘেয়ে সুর দিতে ।
আঁধার হতে না হতে সব শেয়াল ওঠে ডেকে
কল্‌মদিঘির ডাঙা পাড়ির থেকে ।
পেঁচার ডাকে বাঁশের বাগান হঠাৎ ভয়ে জাগে ,
তন্দ্রা ভেঙে বুকে চমক লাগে ।
বাদুড়-ঝোলা তেঁতুলগাছে মনে যে হয় সত্যি ,
দাড়িওয়ালা আছে ব্রহ্মদত্যি ।
রাতের বেলায় ডোমপাড়াতে কিসের কাজে
তাক্‌ধুমাধুম বাদ্যি বাজে ।
তখন ভাবি , একলা ব ‘ সে দাওয়ার কোণে
মনে-মনে ,
ঝড়েতে কাত জারুলগাছের ডালে ডালে
পির্‌ভু নাচে হাওয়ার তালে ।
শহর জুড়ে নামটা ছিল , যেদিন গেল ভাসি
হলুম বনগাঁবাসী ।
সময় আমার গেছে ব ‘ লেই সময় থাকে পড়ে ,
পুতুল গড়ার শূন্য বেলা কাটাই খেয়াল গ ‘ ড়ে ।
সজনেগাছে হঠাৎ দেখি কমলাপুলির টিয়ে —
গোধূলিতে সুয্যিমামার বিয়ে ;
মামি থাকেন , সোনার বরন ঘোমটাতে মুখ ঢাকা ,
আলতা পায়ে আঁকা ।
এইখানেতে ঘুঘুডাঙার খাঁটি খবর মেলে
কুলতলাতে গেলে ।
সময় আমার গেছে ব ‘ লেই জানার সুযোগ হল
‘ কলুদ ফুল ‘ যে কাকে বলে , ওই যে থোলো থোলো
আগাছা জঙ্গলে
সবুজ অন্ধকারে যেন রোদের টুক্‌রো জ্বলে ।
বেড়া আমার সব গিয়েছে টুটে ;
পরের গোরু যেখান থেকে যখন খুশি ছুটে
হাতার মধ্যে আসে ;
আর কিছু তো পায় না , খিদে মেটায় শুকনো ঘাসে ।
আগে ছিল সাট্‌ন্‌ বীজে বিলিতি মৌসুমি ,
এখন মরুভূমি ।
সাত পাড়াতে সাত কুলেতে নেইকো কোথাও কেউ
মনিব যেটার , সেই কুকুরটা কেবল ই ঘেউ-ঘেউ
লাগায় আমার দ্বারে ; আমি বোঝাই তারে কত ,
আমার ঘরে তাড়িয়ে দেবার মতো
ঘুম ছাড়া আর মিলবে না তো কিছু —
শুনে সে লেজ নাড়ে , সঙ্গে বেড়ায় পিছু পিছু ।
অনাদরের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে পিঠের ‘ পরে
জানিয়ে দিলে , লক্ষ্মীছাড়ার জীর্ণ ভিটের ‘ পরে
অধিকারের দলিল তাহার দেহেই বর্তমান ।
দুর্ভাগ্যের নতুন হাওয়া-বদল করার স্থান
এমনতরো মিলবে কোথায় । সময় গেছে তারই ,
সন্দেহ তার নেইকো একেবারেই ।
সময় আমার গিয়েছে , তাই গাঁয়ের ছাগল চরাই ;
রবিশস্যে ভরা ছিল , শূন্য এখন মরাই ।
খুদকুঁড়ো যা বাকি ছিল ইঁদুরগুলো ঢুকে
দিল কখন ফুঁকে ।
হাওয়ার ঠেলায় শব্দ করে আগলভাঙা দ্বার ,
সারাদিনে জনামাত্র নেইকো খরিদ্দার ।
কালের অলস চরণপাতে
ঘাস উঠেছে ঘরে আসার বাঁকা গলিটাতে ।
ওরই ধারে বটের তলায় নিয়ে চিঁড়ের থালা
চড়ুইপাখির জন্যে আমার খোলা অতিথশালা ।

সন্ধে নামে পাতাঝরা শিমূলগাছের আগায় ,
আধ-ঘুমে আধ-জাগায়
মন চলে যায় চিহ্নবিহীন পস্‌টারিটির পথে
স্বপ্নমনোরথে ;
কালপুরুষের সিংহদ্বারের ওপার থেকে
শুনি কে কয় আমায় ডেকে —
“ ওরে পুতুলওলা
তোর যে ঘরে যুগান্তরের দুয়ার আছে খোলা ,
সেথায় আগাম-বায়না-নেওয়া খেলনা যত আছে
লুকিয়ে ছিল গ্রহণ-লাগা ক্ষণিক কালের পাছে ;
আজ চেয়ে দেখ্‌ , দেখতে পাবি ,
মোদের দাবি
ছাপ-দেওয়া তার ভালে ।
পুরানো সে নতুন আলোয় জাগল নতুন কালে ।
সময় আছে কিংবা গেছে দেখার দৃষ্টি সেই
সবার চক্ষে নেই —
এই কথাটা মনে রেখে ওরে পুতুলওলা ,
আপন-সৃষ্টি-মাঝখানেতে থাকিস আপন-ভোলা ।
ওই যে বলিস , বিছানা তোর ভুঁয়ে চেটাই পাতা ,
ছেঁড়া মলিন কাঁথা —
ওই যে বলিস , জোটে কেবল সিদ্ধ কচুর পথ্যি —
এটা নেহাত স্বপ্ন কি নয় , এ কি নিছক সত্যি ।
পাস নি খবর , বাহান্ন জন কাহার
পাল্‌কি আনে — শব্দ কি পাস তাহার ।
বাঘনাপাড়া পেরিয়ে এল ধেয়ে ,
সখীর সঙ্গে আসছে রাজার মেয়ে ।
খেলা যে তার বন্ধ আছে তোমার খেলনা বিনে ,
এবার নেবে কিনে ।
কী জানি বা ভাগ্যি তোমার ভালো ,
বাসরঘরে নতুন প্রদীপ জ্বালো ;
নবযুগের রাজকন্যা আধেক রাজ্যসুদ্ধ
যদি মেলে , তা নিয়ে কেউ বাধায় যদি যুদ্ধ ,
ব্যাপারখানা উচ্চতলায় ইতিহাসের ধাপে
উঠে পড়বে মহাকাব্যের মাপে ।
বয়স নিয়ে পণ্ডিত কেউ তর্ক যদি করে
বলবে তাকে , একটা যুগের পরে
চিরকালের বয়স আসে সকল-পাঁজি-ছাড়া
যমকে লাগায় তাড়া । ”

এতক্ষণ যা বকা গেল এটা প্রলাপমাত্র —
নবীন বিচারপতি ওগো , আমি ক্ষমার পাত্র ;
পেরিয়ে মেয়াদ বাঁচে তবু যে-সব সময়হারা
স্বপ্নে ছাড়া সান্ত্বনা আর কোথায় পাবে তারা ।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *