Opremer Kobita অপ্রেমের কবিতা– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

অপ্রেমের কবিতা
– শামসুর রাহমান

এক্ষুণি বলে ফেলা দরকার, নইলে খুব বেশি
দেরি হয়ে যাবে। সত্যাসত্য নিয়ে ঝাক্কিঝামেলা,
তর্কাতর্কি মূলতুবি রেখে
বোধোদয়ের বাগান থেকে
পরগাছাগুলোকে একটু হাত লাগিয়ে
উপড়ে ফেলা যাক
সময় আমাকে তাড়া করে। গাছে লটকানো
হিস্পানি গিটার জপায়, স্বীকারোক্তি চাই।

এতদিন যে তাসের ঘর তৈরি হয়েছিল
আমার মনের খেয়ালে, বৈরী হাওয়ার ফুৎকারে
তা লহমায় ভূমিসাৎ। অগ্নিবলয়ের এপার থেকে
দেখলাম, একটা জতুগৃহ গলে গলে
মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সেই
অগ্নিকাণ্ডের তাণ্ডবমুক্ত একটি পাথরে
তোমার নাম উৎকীর্ণ করতে গিয়ে বানানের
বিসমিল্লায় গলদ, চৌদিকে হাহা হিহি।
করজোড়ে তোমার কাছে মাফ চাই। কবুল করি, এতদিন
তোমাকে নিয়ে যে ছাইভস্ম লিখেছি বার বার, তার
কোনো মাথামুণ্ডু নেই, কোনো বুনিয়াদই নেই।
মিথ্যার নকল নক্ষত্রখচিত কাঁচুলি নিয়ে খেলা করাই
আমার দ্বিতীয় স্বভাব, এতদিনে তোমার
অজানা থাকার কথা নয়,
তোমার যে হাত কখনো স্পর্শ করার
সুযোগ কিংবা সাহস আমার হয়নি,
তোমার যে ঠোঁট কখনো যুক্ত হয় নি আমার ওষ্ঠে,
তাদের কলুষিত করেছে আমার মিথ্যা বয়ান।

আমার এমনই বসিব, কল্পনা আমাকে ফুসলিয়ে
তিলকে তাল বানিয়ে নিয়েছে। ভালোবাসার
কাঙাল আমি, তোমার মধুর সৌজন্যকে
তরজমা করে নিয়েছি প্রেমে এবং আমার বেহুদা
বেশরম কলম, অতিরঞ্জনে বেজায় দড়, তোমাকে
পর্বে পর্বে বিব্রত করেছে। এই মুহূর্তে ওর গালে চড়
কষাতে ইচ্ছে করেছে; কেননা সে ছন্নছাড়া,
অবাস্তব স্তবকের রচয়িতা।
আমার কলমের বেহায়াপনায়, রংবাজিতে
আমি নিজেই তাজ্জব।
তোমাকে প্রবাল সিঁড়ি থেকে নামিয়ে আমার
কল্পনাজীবী লেখনী আমার বাঁ পাশে
বসিয়ে দিয়েছে জ্যোৎস্নাধোয়া দোলনায়।
তুমি আমার আলিঙ্গনে
ছিপছিপে নৌকোর দোলা, এরকম একটা ছবি
ফোটে তার কয়েকটি আঁচড়ে।

তুমি আমাকে কখনো এমন কিছুই বলোনি,
যাতে মনে হতে পারে তোমার হৃদয়ে
আমার উদ্দেশে ছিল ভালোবাসার বিচ্ছুরণ।
রৌদ্র-জ্যোৎস্না, পানিতে টইটুম্বুর দীঘি
আর হাওয়ায় স্পন্দিত গাছের পাতার ঝিলিমিলি
যা কিছু জপিয়েছে আমাকে
তাকেই তোমার উচ্চারণ ঠাউরে
আমি খুশিতে ডগমগ
যদি তুমি ভুলে যাও আমার বলপেনের
অপরিণামদর্শী উচ্ছলতা, তাহলে আমার
অপরাধের বিষবৃক্ষ উৎপাটিত শেকড়বাকড় সমেত।
যদি বলো, এই বেল্লিককে ছুঁড়ে ফেলে দিই
শ্মশানঘাটের দাউ দাউ চিতায়
অথবা মাছের মড়ক লাগা বুড়িগঙ্গায়।

এতকাল আমার যে অক্ষরমালা
তোমার গলায় পরিয়েছি বলে ঢি ঢি
পড়ে গ্যাছে পাড়ায় পাড়ায়, আসলে তার
একটি মুক্তোও সাচ্চা নয়,
এটা কেউ একবারও ভেবে দেখলে না।
তুমি ছাড়া কে ওদের বলে দেবে যে, যদি কেউ
জলাশয় ভেবে মরীচিকার পেছনে ছুটে মরে দিশেহারা
তবে ভ্রষ্ট পথিকের আর্তনাদের জন্যে
মৃগতৃষ্ণিতাকে দায়ী করা অন্যায়।
কী আনন্দ পায় ওরা বেবুনিয়াদ ছায়ার মহল বানিয়ে?

যারা আমাকে সাতবার
মাটিতে পুঁতে ফেটে পড়ে অট্রহাসিতে
আর গায়েব লাঠিসোটা নিয়ে
লড়াই করে আমার ছায়ার সঙ্গে দিনভর, রাতভর,
আমার হাতে স্বরচিত মিথ্যার কাঁচুলি দেখেই তারা ঠাউরে
নিয়েছে সত্যের নগ্নতার সঙ্গে আমার মাঝামাখি।

আমার এই স্বীকারোক্তির পর
কেউ আর তোমাকে দেখে মুখ টিপে হাসবে না,
বিব্রত হবে না তুমি
আমার লজ্জা আর পাপ উন্মোচন করে
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি তোমাদের সবাইকে মুক্তি দিলাম।
মনগড়া ভুল স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে থেকে
চড়ায় মুখ থুবড়ে রক্ত ভেজা বুকে
কীভাবে বেঁচে থাকা যায়
ভালোবাসার চৌচির খরায়, এখন থেকে
এটাই আমার অনুশীলন।

হঠাৎ লেখার টেবিলে আমার কলম
স্যামসনের মতো পেশী ফুলিয়ে, ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে
গরগরে স্বরে করলো উচ্চারণ-
‘আমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দিয়ে
কার কার মুখ বন্ধ করতে চাও, কবি?’

(হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *