Niruddesh Deyal নিরুদ্দেশ দেয়াল– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

নিরুদ্দেশ দেয়াল
– শামসুর রাহমান

মুহূর্তে মুহূর্তে ভীতি, বদ্ধ কালা চার দেয়ালের
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মগজের কোষে। এমন কি
মস্তিষ্কে দেয়াল গেঁথে হো-হো হেসে ওঠে বহু লোক,
কোপন স্বভাবী লোক। “কী দরকার দেয়াল-পেরুনো
দৃষ্টির দিব্যতা দিয়ে” বলে তারা অভ্যাসের বশে
সত্তার চৌদিকে তোলে পাথুরে দেয়াল ঝোড়ো হাতে।

যতই নিরেট হোক, দেয়ালটা থাকুক আমাকে
ঘিরে পাহারায়,
দৃষ্টি তবু যায় দূরে, দরজা-জানালা
থাকে পড়ে। পা’দুটো কী করে ব্যস্ততায় খোঁজে পথ
গর্তের ভিতর, যাকে বলি ঘর। ডুসেলডর্ফের
পোড়-খাওয়া পথপ্রান্তে যেতে চাই, অস্ট্রিয়ান বাড়ির বাগানে
যে তরুণী ফুল তোলে, নোয়ায় কম্পিত ডাল, যার
স্তনভারে সূর্যগন্ধী ফলের সোনালি-অন্য মনে
গভীর গোলাপটিকে হাওয়ায় দুলিয়ে জীবনের
মানে বলে বাক্যের অতীত- তারই কাছে সারাবেলা
কেবলি পৌঁছুতে চাই।

কায়রোর কফির দোকানে
এক কোণে বসে বসে দৃশ্য গাঁথি, মিনারের মতো প্রবীণ যে ভদ্রলোক
খাচ্ছেন সুগন্ধ কফি, ইচ্ছে হয় বলি তাঁকে, “কেমন আছেন?”
ন্যুইয়র্কে যে বালক বল নিয়ে লাফাতে লাফাতে
ঘোরানো সিঁড়িতে ওঠে, ছায়া দেখে ভয় পায়, তাকে বুকে নিয়ে
হরবোলা সেজে জেনে নিতে চাই কী যে তার নাম। ক্যাথিড্রাল
বড়ো রাস্তাটার ডান দিকে রেখে ইচ্ছে হয় গ্র্যাণ্ড ক্যানালের
গণ্ডোলায় দুলি কিছুক্ষণ, দু’দণ্ড বিশ্রাম নিই
প্যারিসের বুলেভারে কিংবা বুদোয়ারে। হাঙ্গেরির
শাদা বাড়িটার
সুদৃশ্য কার্ণিশ ঘেঁষে ভোরের আলোয় মাখা যে পায়রাগুলো
উড়ে যায়, শূন্যতাকে চেয়ে বার বার,
মাদ্রিদের লিরিক জ্যোৎস্নায় আধ-পাগলা যে লোকটা
গত শতকের ঢের কুহক সঞ্চারী শোকগাথা করছে রচনা আর
গীটার ধ্বনিতে এলদেরাদোর ছবি চৈতন্যে জাগায়,
ছন্নছাড়া তাকে, সেই পায়রাগুলোকে
চোখ ভরে দেখবার, সবখানে পৌঁছুবার, রেড স্কোয়ারের
মিশ্র ভিড়ে, পিকিং-এর প্রাণের মেলায়, সবখানে
পৌঁছবার খোলা রাস্তা চাই।

টপকে প্রাক্তনী চোরাবালি হঠকারী যে মদ্যপ
অমিত্রাক্ষরের মায়ামন্ত্রে সেই ঊনিশ শতকে
সমুদ্রে ভাসালো পোত, আমি তার উত্তরাধিকারী-
শিরায় শব্দের ঝোড়ো গান, চৈতন্যের নীলিমায়
সারসের পক্ষধ্বনি শুনি, কী আবেগে অকস্মাৎ
দেয়াল চাহিদ হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।

(বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *