Mormubani মর্মবাণী– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Rabindranath Tagor

Rate this Book

মর্মবাণী
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শিল্পীর ছবিতে যাহা মূর্তিমতী,
গানে যাহা ঝরে ঝরনায়,
সে বাণী হারায় কেন জ্যোতি,
কেন তা আচ্ছন্ন হয়ে যায়মুখের কথায়
সংসারের মাঝে
নিরন্তর প্রয়োজনে জনতার কাজে?
কেন আজ পরিপূর্ণ ভাষা দিয়ে
পৃথিবীর কানে কানে বলিতে পারিনে “প্রিয়ে
ভালোবাসি”?
কেন আজ সুরহারা হাসি
যেন সে কুয়াশা মেলা
হেমন্তের বেলা?
অনন্ত অম্বর
অপ্রয়োজনের সেথা অখণ্ড প্রকাণ্ড অবসর,
তারি মাঝে কে তারা অন্য তারকারে
জানাইতে পারে
আপনার কানে কানে কথা।
তপস্বিনী নীরবতা
আসন বিস্তীর্ণ যার অসংখ্য যোজন দূর ব্যেপে
অন্তরে অন্তরে উঠে কেঁপে
আলোকের নিগূঢ় সংগীতে।
খণ্ড খণ্ড দণ্ডে পলে ভারাকীর্ণ চিতে
নাই সেই অসীমের অবসর;
তাই অবরুদ্ধ তার স্বর,
ক্ষীণসত্য ভাষা তার।
প্রত্যহের অভ্যস্ত কথার
মূল্য যার ঘুচে,
অর্থ যায় মুছে।
তাই কানে কানে
বলিতে সে নাহি জানে
সহজে প্রকাশি’
“ভালোবাসি”।
আপন হারানো বাণী, খুঁজিবারে,
বনস্পতি, আসি তব দ্বারে।
তোমার পল্লবপুঞ্জ শাখাব্যূহভার
অনায়াসে হয়ে পার
আপনার চতুর্দিকে মেলেছে নিস্তব্ধ অবকাশ।
সেথা তব নিঃশব্ধ উচ্ছ্বাস
সূর্যোদয় মহিমার পানে
আপনারে মিলাইতে জানে।
অজানা সাগর পার হতে
দক্ষিণের বায়ুস্রোতে
অনাদি প্রাণের যে বারতা
তব নব কিশলয়ে রেখে যায় কানে কানে কথা,–
তোমার অন্তরতম–
সে কথা জাগুক প্রাণে মম;–
আমার ভাবনা ভরি উঠুক বিকাশি
“ভালোবাসি”।
তোমার ছায়ায় বসে বিপুল বিরহ মোরে ঘেরে;
বর্তমান মূহূর্তেরে
অবলুপ্ত করি দেয় কালহীনতায়।
জন্মান্তর হতে যেন লোকান্তরগত আঁখি চায়
মোর মুখে।
নিষ্কারণ দুখে
পাঠাইয়া দেয় মোর চেতনারে
সকল সীমার পারে।
দীর্ঘ অভিসারপথে সংগীতের সুর
তাহারে বহিয়া চলে দূর হতে দূর।
কোথায় পাথেয় পাবে তার
ক্ষুধা পিপাসার,
এ সত্য বাণীর তরে তাই সে উদাসী
“ভালোবাসি”।
ভোর হয়েছিল যবে যুগান্তের রাতি
আলোকের রশ্মিগুলি খুঁজি সাথি
এ আদিম বাণী
করেছিল কানাকানি
গগনে গগনে।
নব সৃষ্টি যুগের লগনে
মহাপ্রাণ-সমুদ্রের কূল হতে কূলে
তরঙ্গ দিয়েছে তুলে
এ মন্ত্রবচন।
এই বাণী করেছে রচন
সুবর্ণকিরণ বর্ণে স্বপন-প্রতিমা
আমার বিরহাকাশে যেথা অস্তশিখরের সীমা।
অবসাদ-গোধূলির ধূলিজাল তারে
ঢাকিতে কি পারে?
নিবিড় সংহত করি এ-জন্মের সকল ভাবনা
সকল বেদনা
দিনান্তের অন্ধকারে মম
সন্ধ্যাতারা সম
শেষবাণী উঠুক উদ্ভাসি–
“ভালোবাসি”।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *