Kobir Oshrur Cheye Dami কবির অশ্রুর চেয়ে দামী– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

কবির অশ্রুর চেয়ে দামী
– শামসুর রাহমান

আমি কি অজ্ঞাতবাসে আছি? এ-রকম থেকে যাবো
গোপনীয় মনোকষ্টে ডুবে বহুদিন দলছাড়া?
কীট-পতঙ্গের সঙ্গে উচ্চারণহীন মেলামেশা,
বিষণ্ণ বিকেলে হ্রদে ভাসমান প্রেমিকের জামা,
আর ঊর্ণাজালের মতই ঝোপঝাড়ে তেজী আলো,
মাথার ওপর উড্ডয়নপরায়ণ একা দীর্ঘপদী পাখি-
ভাবি আজো নিসর্গের পৃষ্ঠপোষকতা
রয়েছে অটুট। গোধুলিতে খোলামেলা
ঢিবির ওপরে ব’সে দেখি জীবনের ঢ্যাঙা ছিরি!

জীবন আমার হাতে কোন সে ঠিকানা গুঁজে দিয়ে
দেখিয়েছে খোলা পথ; পথে
তৃণ ছিলো, কাঁটাঝোপ ছিলো, ছিলো সাঁকো,
হরিণের লাফ ছিলো, উজ্জ্বল সাপের
হিস্‌হিস্‌ ছিলো, কিছু কাটাকুটি, কিছু ভুল ছিলো-
ভাবতে-ভাবতে হাঁটি, কায়ক্লেশে হাঁটি,
কখনো নিঝুম ব’সে থাকি পথপ্রান্তে, ক্ষয়ে-যাওয়া
দাঁতে ছায়া চিবোতে-চিবোতে দিন যায়।
দিন যায়,
কখনো-কখনো খুব সহজে যায় না।
কোনো-কোনো ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই কষ্ট পাই,
বিষণ্ণতা ব্যেপে আসে শ্রাবণের মেঘের ধরনে,
উদ্যানের পাশে
কী এক সৌন্দর্য ফৌত হয়ে প’ড়ে থাকে, মনে হয়
পুরোনো কবর থেকে কোনো পূর্বপুরুষ আমার
বেরিয়ে এলেন পৌরপথে, প্রতিকার চেয়ে-চেয়ে
পুনরায় ত্বক-মাংস তাঁর খ’সে যায়, খ’সে যায়,
বুঁজে আসে কবরের চোখ। দিন খুব
দীর্ঘ লাগে, দীর্ঘশ্বাসে-দীর্ঘশ্বাসে প্রহর উদাস।

মাঝরাতে যখন ভীষণ একা আমি,
যখন আমার চোখে ঘুম নেই একরত্তি, আমি
বিপর্যস্ত বিছানায় প’ড়ে আছি ক্রশের ধরেন,
তখন অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে
কে এক নৃমুন্ডধারী অশ্ব এসে বলেঃ
শোনো হে তোমার
নিজের শহরে আজ আমাদের রাজ
পাকাপোক্ত হলো;
দ্যাখো চেয়ে আমাদের সংকেতবহুল
পোস্টারে-পোস্টারে
ছেয়ে গ্যাছে শহরের প্রতিটি দেয়াল আর ছায়া-কেবিনেটে
জ্যোতিশ্চক্রগুলি নৃত্যপর, কবিসংঘ এই অশ্ব সমাজের,
মানে আমাদের সমর্থনে দিনরাত্রি
বেহাল কাটায় দীর্ঘ স্তোত্র রচনায়।

তোমার শহরে, শোনো, একটিও ভিক্ষুক নেই আর।
হাসপাতালের সব বেড খালি, কেননা এখন
আর রোগী নেই কেউ। পাগলাগারদও আজ বাশিন্দাবিহীন,
অতিশয় পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকগুলো কুচকাওয়াজের ঢঙে
দিব্যে হেঁটে যায়
নতুন মুদ্রার মতো চকচকে রাস্তায়-রাস্তায়!
বাছা-বাছা যুক্তিবাদী রাজনীতিবিদ
পরিবর্তনের গূঢ় পতাকা পকেটে পুরে নব্য খোয়ারিতে
ছায়াস্নিগ্ধ বনভোজনের চমৎকার
মানুসরুটি খেয়ে
দাঁত খুঁটছেন ঘন-ঘন আর মাঝে-মাঝে
দরাজ গলায় গান ধরেন পার্টিতে ফের অকস্মাৎ ঘুমিয়ে পড়েন
প্রতারক জ্যোৎস্নার কার্পেটে।

ফলস্‌ ত্র্যালার্ম শুনে ভয় পেও না বেহুদা, ছুটে
যেও না বাইরে, চোখ-কান বুঁজে প’ড়ে থেকো নিজস্ব শয্যায়
বিপদকে গ্রেপ্তার করেছি আমরা, বিপুল ধ্বংসকে
পাঠিয়েছি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, তোমার নিজের
শহরকে খলখলে রক্ষিতার মতো সাজিয়ে দিয়েছি
আপাদমস্তক অহংকারী অলংকারে।

আমার ব্যর্থতা
কবরখানার হল্‌দে ঘাসে নাঙা সন্ন্যাসীর মতো
শুয়ে থাকে সাবলীল,
আমার ব্যর্থতা ফণিমনসার মতো তীক্ষ্ম অহংকারে
রৌদ্রজ্যোৎস্না পোহার নিয়ত,
আমার ব্যর্থতা টাওয়ারের প্রতি বাড়িয়ে দু’হাত
ধুলোয় গড়াতে থাকে কখনো-বা শিস দিতে-দিতে
চলে যায় নিরুদ্দেশে, বেকার যুবার মতো ছেঁড়া জুতো পায়ে
পথে-পথে ঘোরে,
সর্বস্বান্ত নবাবের মতো চেয়ে থাকে সূর্যাস্তের দিকে বড়ো
উদাসীন, গলির দোকান থেকে সিগারেট কেনে ধারে আর
আমার ব্যর্থতা ব্যর্থ কবির ধরনে
খুব হিজিবিজি কাটাকুটির অরণ্যময় কালো খাতা খুলে
ব’সে থাকে, সিগারেট ঠোঁটে, ছাই ঝ’রে যায়, শুধু
ছাই ঝ’রে যায়।

এইসব কথা লিখে অধিক রাত্তিরে কবি ধূসর বালিশে
মুখ চেপে কাঁদে, রক্তে মাংসে হাড়ে ও মজ্জায় ঝরে
কান্না ঝরে অবিরল।
কবির অশ্রুর চেয়ে দামী মায়াময় অন্য কিছু আছে কি জগতে?

(ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *