Kaldirno Kokiler Moto কালদীর্ণ কোকিলের মতো– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

কালদীর্ণ কোকিলের মতো
– শামসুর রাহমান

অপার প্রসন্নতায় ছিলেন তিনি ঘর-দুয়ার
আগলে; নোংরা গলিতে,
রাস্তায় রাস্তায় বাজতো
তাঁর জুতোর আওয়াজ বাদ্যযন্ত্রের মতো। কখনো
দেখা যেত, হেঁটে চলেছেন
তিনি প্রান্তরের নীল প্রান্ত ঘেঁষে,পেরুচ্ছেন সাঁকো,
শস্যক্ষেতের ফসল ছাপিয়ে
জেগে উঠছে হরফ আলিফ-এর মতো তাঁর
ঋজু আর অনন্য শরীর। বনরাজিনীলার রহস্যময়তা
আর ডাগর নদীর ছলাৎছল শব্দ
কণ্ঠে ধারণ ক’রে তিনি সকলের জন্যে গাইতেন
ঘর ছাড়ার কীর্তন, ঘরে ফেরার গোধূলিপ্রতিম পদাবলী

তাঁর সুরে বিষ-কাটালির ঝোপঝাড়
রূপান্তরিত হতো রজনীগন্ধাবনে, গুচ্ছ-গুচ্ছ পলাশে
চেয়ে যেত মেঘের পাড়,
নদী হতো অজস্র নারীর কলস্বর,
পাহাড় মস্তিতে ভরপুর দরবেশ। সে-গানে
আকাশ পরতো সূর্যের মুকুট।
সেই গীতধারায়
স্নাত গাছপালা পেতো স্বর্গীয় সৌন্দর্য।
অলংকারহীন সে-গান পান্থশালায়,
গেরস্তের কুটিরে, কারখানার চত্বরে চত্বরে,
খনির সুড়ঙ্গে, হাসপাতালের করিডোরে, ঝর্ণার ধারে
উড়ে-আসা পাতায়,
বেকারের বিবরে কী ব্যাপক
ছড়িয়ে পড়তো যেন স্মৃতিমুখর তেজালো জোয়ার।

যত অন্তরারেই থাকুন তিনি, সে-গান
ঘোষণা করে তাঁর উপস্থিতি। ঘোর অমাবস্যায়
তাঁর হাতের মুঠোর থেকে ছল্‌কে পড়ে জ্যোৎস্না,
চোখ থেকে ঝরে ফুলের রেণু,
জামার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে
রঙ-বেরঙের পাখির ঝাঁক। তিনি যখানেই যান,
তাঁর সঙ্গে যায় লোক, রাস্তা-উপচে-পড়া লোক,
যেন তিনি এক মোহন ঐন্দ্রজালিক,
যার ইঙ্গিতে মাটিতে মুখ-থুবড়ে-পড়ে-থাকা শহর
নিমেষে তোলে মাথা,
মৌরসীপাট্রার ভুয়া দলিল দস্তাবেজ পুড়ে যায়
এবং বেজায় ছত্রভঙ্গ আততায়ীর দল।

প্রহরে প্রহরে ওদের বেয়নেট শাসালো তাঁকে, ওর
ভেবেছিল এতেই নড়বে টনক,
কিন্তু যাঁর ভিতরে গুঞ্জরিত কবিতার ঝলক, তিনি কেন
মাতা নত করবেন পিস্তল আর বন্দুকের নলের অভিযোগের
সামনে? কেন তিনি নিজের স্বপ্নমালাকে
দলিত হতে দেবেন উন্মত্ত হাতির পারের পায়ের তলায়?

আখেরে তাঁর, সেই কবির, ঠাঁই হলো আকাশ-ছোঁয়া
দেয়াল-ঘেরা কয়েদখানায়। দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস যায়, অর্ধাহারে,
একাতিত্বের দংশনে গুকায় তাঁর শরীর, হাড়ে ধরে ঘুণ,
অথচ তাঁর আত্মায়
বিরতিহীন দেয়ালি, মৌন উৎসবের নহবৎ।

ওরা ভেবেছিল, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ
করলেই, তাঁর পিঠে চাবুকের চেঁচিয়ে-ওঠা ছোবলে
কালসিটে পড়লেই রুদ্ধ হবে
দূরন্ত এক কাহিনীর গতি, কিন্তু তাঁর কবিতাবলিকে
ওরা হাতকড়া পরাতে পারেনি কিংবা বেড়ি। পৃথিবীর
কোনো কয়েদখানারই সাধ্য নেই
তাঁর ঈগলের মতো কবিতাকে
আটকে রাখতে পারে, ডানা তার ঝলসায় আকাশে আকাশে।

উত্যক্ত হয়ে ওরা একদিন কবিকণ্ঠে
পরালো মৃত্যুর ফাঁস; আর কী আশ্চর্য, ফাঁসির মঞ্চে
ঝুলন্ত কবির শরীরর প্রতিটি রোমকূপ থেকে বিচ্ছূরিত হলো
কবিতার পর কবিতা, যেন মেঘকৃষ্ণ গর্জনশীল আসমানে
বিদ্যুচ্চমক এবং সেই কবিতাবলি কালদীর্ণ কোকিলের মতো ডেকে
ডেকে
ভীষণ রক্তিম ক’রে তুললো নিজেদের চোখগুলো।

(অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *