Itihas , Tumake ইতিহাস, তোমাকে– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

ইতিহাস, তোমাকে
– শামসুর রাহমান

করাতের অসংখ্য দাঁতের মতো মুহূর্তগুলো
আমাকে কামড়ে ধরেছিল, আর সেই মরণ-কামড়ে
আমি ঝাঁঝরা শরীরটাকে দু’ একবার নেড়েচেড়ে
পৃথিবীর বন্ধ দরজা নখ দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে
নিঃসাড় হয়ে যেতে পারতাম।
কিন্তু আমার দুঃখ-চর্চিত ললাটে
অন্য সম্মানের আভাস ছিল বলেই
বেঁচে রইলাম। তৃষ্ণার দুপুরে কোনো আহত সাপের মতো
এক সীমাহীন ক্রোধে, মূর্খ যন্ত্রণায় নিজেকে টেনেহেঁচড়ে
বেঁচে রইলাম সর্বনাশের পাশ কাটিয়ে
সমস্ত দুর্দশার মুখের ওপর আমার প্রবল থাবা মেলে দিয়ে।

জীবনকে খণ্ড খণ্ড চিত্রে দেখেছি-কখনো সুন্দর
কখনো কুৎসিত। যুবককে দেখেছি
দুপুর সন্ধ্যা আর রাত্রিকে রেণুর মতো
উড়িয়ে দিতে হাওয়ায় আর বৃদ্ধকে দেখেছি তার
খাটো মোমবাতিটাকে হিংসুক বাতাসের
বিরোধিতা থেকে রক্ষা করার জন্য কী ব্যস্তবাগীশ।

কখনো অশেষ হঠকারিতায় জীবনকে একটা
আংটির মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চেয়েছি,-কখনো
সময়ের জরায়ু ছিঁড়ে নিতে চেয়েছি
কয়েকটি টসটসে নিটোল কালো আঙুর,
যাদের আমি ঠোঁটে নিয়ে থেঁতলে দিতে, পিষে ফেলতে
ভালবাসি, ভালবাসি যাদের মাংসল কণাগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে
ইতিহাসের হলুদ জঞ্জালে।
পেঁজা তুলোর মতো তুষারে অশ্বেতরের
পায়ের ছাপ, সোনালি গমের মাঠ
আগুনের লকলকে জিভ কিংবা ধোঁয়াটে
সন্ধ্যার প্রান্তরে খণ্ডিত সৈনিক
একেই বলবে কি ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবৃতি?

একটি আলোকিত দেহকে বিনাশ করবে বলে যারা
ক্রুশকাঠে পেরেক ঠুকেছিল, তাদের
উৎসব, ব্যভিচার কিংবা যারা বালিতে, অন্ধকার
গুহার দেয়ালে মাছের চিত্র এঁকে
ক্রুশবিদ্ধ অস্তিত্বের মহাপ্রয়াণে চোখ মুছেছিল,
তাদের ঘরকন্না, প্রেমের ব্যাপ্ত বলয়, তা-ও কি
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় প্রতারক ইতিহাসের?

ইতিহাস সরোদের মতো বেড়ে উঠলে
আমি সুখী, দামামার মতো গর্জে উঠলে
দুঃখ আমাকে বিবর্ণ করে। জীবন যখন বর্বরের মুঠোয়
কপোতের নরম বুকের মতো কেঁপে ওঠে,
গহন পাতালের প্রাগৈতিহাসিক শীতল জল
নিভিয়ে দিতে চায় হৃদয়ের আগুন,
আমার সমস্ত সম্ভ্রম আর উল্লাস
অর্পণ করি আগামীর অঞ্জলিতে
‘কেননা ভবিষ্যৎ এক
জলদমন্দ্র সুর ইতিহাসের ধ্রুপদী আলাপে।

(রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *