Eto Din Je Kobita Amar Lekha Hoyni এতদিন যে-কবিতা আমার লেখা হয়নি– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

এতদিন যে-কবিতা আমার লেখা হয়নি
– শামসুর রাহমান

নির্ঘুম বসে ছিলাম একলা ঘরে,
হাত-ঘড়িতে তখন রাত তিনটা। বাইরে
অন্ধকার আদিম জন্তুর মতো মাথা গুঁজে জমিনে
ঘুমিয়ে আছে। অকস্মাৎ সেই জন্তু
মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে প্রসারিত ক’রে
ওর দাঁত-নখে কামড়ে ধরলো ঘুমন্ত শহরকে। কেঁপে
উঠলো চেয়ার, আমার লেখার টেবিল। ভূমিকম্প ভেবে
বাইরে ছুটে গিয়ে
চেয়ারেই আটকে থাকলাম, যেন কেউ আমাকে
আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে আমার চিরচেনা আসনে।

সেই মুহূর্তে, পরদিন প্রচারিত হলো লোকমুখে,-
সংবাদপত্রের পাতায়-আমার এই
জন্মশহরের ঐতিহ্যখচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রীনিবাসে রাত তিনটায় চলছিল হায়েনাদের তাণ্ডব,
নিদ্রাছুট ছাত্রীগণ পথ পাচ্ছিল না আত্মারক্ষার। আব্রু
হারানোর শঙ্কায় লুকোতে গিয়েও
ওদের অঙ্গবাসে পড়লো টান, আলুলায়িত বেণী,
খসে-পড়া খোঁপা পোশাক সজ্জিত জান্তব সন্ত্রাসে হলো লাঞ্ছিত।

সেই মুহূর্তে আশপাশের গাছপালা শাসন-না-মানা ক্রোধে
কাঁপতে কাঁপতে ছুটে যেতে চেয়েছিল
ছাত্রীনিবাসে, কিন্তু, হায়, ওদের শেকড় বন্দী কঠোর মাটিতে।
সেই মুহূর্তে শান্ত বুড়িগঙ্গা নদী ধিক্কারে ফুঁসে
উঠছিল খুব, অথচ বড় নাচার সেই জলধারা
তটে মাথা কুটেও পারলো না
ছুটে গিয়ে জালিমদের ভাসিয়ে
নিয়ে যেতে। নাগরিকগণ তখন ঘুমে অচেতন।

এ কেমন দূষিত, পচন-ধরা কালে নিঃশ্বাস নিচ্ছি? আমরা
সবাই কি ঠুঁটো জগন্নাথ হ’য়ে বসে থাকবো অষ্টপ্রহর?
আমরা কি আহারান্তে পান চিবিয়ে,
সিগারেট ফুঁকে, আড্ডায় গা ভাসিয়ে কাটিয়ে
দেবো সময়? আমরা কি ঘুমিয়ে থাকবো কালবেলায়?
আমরা কি আমাদের ভগ্নি কন্যাদের
বস্ত্রহরণ পর্বে নির্লজ্জের মতো নিষ্প্রাণ পুতুল হয়ে থাকবো?
আমরা কি তখনও ফেটে পড়বো না বিস্ফোরণে?

পাড়ায় পাড়ায় কখন কত কী-যে হারায়,
অনেকেই বোঝে না, কেউ কেউ বোঝে। তুমি কি তোমার
ভাঙা গালে হাত দিয়ে ব’সে ভাবতে থাকবে কারা কোথায়
কী লুটে নিলো, কারাই বা হলো বঞ্চিত? ভাবনারা
মৌমাছি হয়ে হুল ফোটাবে তোমার অস্তিত্বে,
তুমি ধৈর্য ধরে সইবে, সবই সইতে থাকবে
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তা হবে না, চলতে দেবো না
সেই খেলা ব’লে গর্জে উঠবে তারুণ্য, আগামীর নকিব।

এই জাঁহাবাজ, দাঁত-নখ-খিচোনো অমাবস্যার
আস্ফালন আমরা কি থামাতে পারবো না?
আমরা কি পারবো না ভয়ঙ্কর কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমা-চাঁদের পথ
সুগম ক’রে দিতে আমাদের
প্রতিবাদের ঝড়ে ঝেঁটিয়ে সকল বাধা? আমরা কি
পারবো না জন্ম দিতে তেমন নতুন যুগকে,
যে-কালে ছদ্মবেশী স্বৈর শাসকের হুঙ্কারে,
অঙ্গুলি হেলনে আজ্ঞাবহ বরকন্দাজদের তাণ্ডবে
ধুলোয় লুটোবে না মানবিক মূল্যবোধ, হিংস্র কাদায়
সমাহিত হবে না অগ্রসর তরুণ তরুণীর স্বপ্ন, আর্তনাদ করবে না সভ্যতা?

(ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *