Ekti Dupurer Upokotha একটি দুপুরের উপকথা– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

একটি দুপুরের উপকথা
– শামসুর রাহমান

সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ,
পাখিদের ওড়াউড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।
রোদ আমার ভেতরে বাজতে থাকে মোহন বাদ্যযন্ত্রের মতো
আর আমি যেন নিভৃত আরোগ্যশালায়
একটু একটু করে স্বাস্থ্য ফিরে পাই। ভোর স্বপ্নের ভাষায়
অপরূপ কোলাহলময় আমার শিরায় শিরায়;
আমি সঙ্গমকালীন একাকিত্বের কথা ভুলে, ভুলে উঠোনের কথা
দিগন্ত আর ধাবমান অশ্বপালের কথা ভাবি।

এখন সেই জাগরণের মুহূর্তে
আমি কি জানতাম কী বিপুল আশ্চর্য অপেক্ষা করছে
আমার জন্যে? কয়েক ঘণ্টা পরেই ঝকঝকে দুপুরে
আমার অস্তিত্বকে উদ্ভাসিত করে একজন
সিঁড়ির ধাপ ছেড়ে
উঠে আসবে আমার বাঁ পাশে? তার দৃষ্টি আর হাসিতে
আমার পরমায়ু হবে গভীর সঞ্জীবিত?

তখন কি আমি জানতাম
দুপুর এমন বাঙ্ময় হতে পারে, হতে পারে কোনো পাখির দীর্ঘ ডাক?

হৃদের ছলছলানি? এমন সম্মোহনময়?
পুলিশের বাঁশি, মাইল মাইলব্যাপী বুটের শব্দ,
বম্ব্যরের মৃত্যুবর্ষী গর্জন, বাতিল শাসনতন্ত্রের হাহাকার
আর পাঁচসালা পরিকল্পনার আর্তনাদ ছাপিয়ে
একটা দুপুর চাইকোভস্কির সুর হতে পারে, আগে জানিনি।
একজন, বহুদিন আগেকার রাত্রির গহন থেকে আফ্রোদিতির মতো
উঠে-আসা একজন, দুপুরকে অনন্য উপহারে রূপান্তরিত করে
আমার উদ্দেশে। সেই উপহার
হাত বাড়ায় আমার দিকে, আমি মুগ্ধাবেশে
পান করি সেই দৃশ্য। দুপুর, আকাশের দিকে বাহু-তোলা গাছ,
রৌদ্রাক্রান্ত পথ, ধাবমান যান আর আমরা দুজন
নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে যাই।
কী সুন্দর তুমি, দুপুর উচ্চারণ করে তোমার কানে কানে;
তুমি হাসো দুপুরকে অবিশ্বাস করে,
সেই হাসি দুপুরকে করে তোলে আরো প্রগলভ।
এই শহুরে দুপুরে অকস্মাৎ ভাবি-
এ দুপুর জানে প্রতিবিপ্লবীর ভ্রান্তির মতো কিছু কথোপকথন
আমাদের আছে,
এ দুপুর জানে ভূমিহীন কৃষকের স্বপ্নের মতো কিছু স্বপ্ন
আমাদের বাস্তবে লতিয়ে ওঠে,
এ দুপুর জানে গুপ্তহত্যার মতো নিঃশব্দ ভয়ংকর কিছু
বারংবার ঘটতে থাকে আমাদের ভেতর,
এ দুপুর জানে ল্যাজারাস আড়মোড়া ভাঙে উদাস প্রান্তরে,
তোমার অনাবৃত বাহুর মতো যেন কোন স্মৃতি
ঝুলে রয় মনের ঝোপঝাড়ে,
এ দুপুর জানে খরগোশেরও ঘাড়ে কিছু কবিতার পঙ্‌ক্তি
মিশে থাকে,
কোথায় ব্যাপক জতুগৃহে অনেকানেক ঘোড়া পুড়ে যায়।
কী সুন্দর তুমি, মনে মনে বলি।
তখন আমার চতুষ্পার্শ্বে ট্রাফিকের মাতলামি,
রাস্তা উপচে-পড়া মানুষ, দোকানপাটের বিজ্ঞাপনী ইশারা,
চিত্রতারকার রঙচঙে ছবি,অথচ আমি
কিছুই দেখি না, শুনি না কিছুই। দুপুরে
আমার দু’চোখ জুড়ে তুমি শুধু তুমি।
কী সুন্দর তুমি, আবৃত্তি করি তোমার সৌন্দর্য
আর হঠাৎ মনে পড়ে, তোমাকে ধরে রাখতে পারব না কখনো।
হয়তো এমন দিন আসবে,
যখন আকাশে সূর্য হাসবে রাষ্ট্রদূতের মতো অথবা চাঁদ
আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক কর্মার মতো
গা-ঢাকা দেবে মেঘের ভূতলে,
কিংবা হলদে পাতার মতো হেমন্ত ছোঁবে আমাকে,
ঝমঝমিয়ে আষাঢ় নামবে এ শহরে
আর আমি নির্বাসিত হবো তোমার সান্নিধ্যের অলকাপুরী থেকে।
চাই, তোমাকেই চাই বলে আমার অস্তিত্ব এক-দীর্ঘ চিৎকারে
রূপান্তরিত হবে, দিনযাপন মনে হবে
নিরন্ধ্র কারাবাসের মতো; আর তোমার উদ্দেশে আমার ডাক
প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে আমারই কাছে বারে বারে।
যখন কোনো কোনো দুঃস্বপ্নসংকুল
রাতে ঘুমের বড়ি সেবন করার পরও ঘুম আসবে না তোমার,
তখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তুমি, চোখ মেলে দিও
ক্ষুধিত অন্ধকারে,
তখন দেখতে পারবে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে একজন
তোমারই প্রতীক্ষায়; কোনো পাহারাদার তাকে ‘দূর হট’ বলে
তাড়াতে পারবে না,
এমনকি আজরাইলের অন্ধ, দুর্বিনীত ডানাও না।

(উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *