Ebong Prokrito Biplobi Moto এবং প্রকৃত বিল্পবীর মতো– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

এবং প্রকৃত বিল্পবীর মতো
– শামসুর রাহমান

আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন, হৃদয়ের ক্ষত
শুঁকি, চাটি বারংবার। বোমাধ্বস্ত শহরে যেমন
নিঃসঙ্গ মানুষ ঘোরে, খোঁজে চেনা মুখ কিংবা
স্বজনের মৃতদেহ, প্রত্যহ আমি তেমনি করি
চলাফেরা একা একা। ধ্বংসস্তূপে চোখ পড়লেই
আমার অস্তিত্ব করে আর্তনাদ। কবেকার গাঢ়

বেহালার সুর বাজে পুনরায়, সভ্যতার পোকা-ছাওয়া মাংস
স্পন্দিত সে সুরে।
একটি ভালুক, লাল, বড় স্তব্ধ, বহুদিন থেকে
নিরিবিলি ঘরে
রয়েছে দাঁড়িয়ে ঠায়। যদি প্রাণ পায় চলে যাবে তাড়াতাড়ি
মৌচাকের খোঁজে দূরে বাড়িটিকে ফেলে। বিটোফেনি সুর ঝরে
তার গায়, চক্ষুদ্বয় অত্যন্ত সজীব হতে চায়। নিরুপায়
অন্ধতায় তার বেলা যায়।

একটি চিঠির খাম পড়ে আছে টেবিলের বুকে গোধূলিতে
নিষ্প্রাণ পাখির মতো। পুরোনো চেয়ার অকস্মাৎ
দূর শতাব্দীর
সিংহাসন হ’য়ে মিশে যায় ফ্যাক্টরির কালো পেঁচানো ধোঁয়ায়।
চতুষ্পার্শ্বে সভ্যতার মতো কিছু গড়ে ওঠে, ভেঙ্গে যায় ফের,
কম্পমান অন্ধকারে একরাশ বেহালা চোখের মতো জ্বলে।
কবির মেধার কাছে সভ্যতা কী চেয়ে বিমুখ হয়ে থাকে
বারংবার? মরণের সঙ্গে দাবা খেলে অবসন্ন কবি,
পাণ্ডুলিপি, ফুল মেঘে ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় অবেলায়।
আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। কবি জনস্রোতে,
মোটরের ভিড়ে বুনো ঘোড়ার মতোন থতমত;
আর্তনাদ করে তার পেশী, চক্ষুঃশিরা যেন স্মৃতি
ক্রন্দনের মতো আসে ব্যেপে অস্তিত্বের কন্টকিত তটে!
চতুর্দিকে বাজে ট্রাফিকের কলরব, চোখ বেয়ে
ঝরঝর মুহূর্ত ঝরে, জনতার পাশাপাশি মৃত্যু হাঁটে,
কোথায় সে গোধূমের ক্ষেত পুড়ে যায়, শূন্য ঘরে
টেলিফোন একটানা বেড়ে চলে, শুনেছো তো, হায়,
রেডিয়োর সন্ধ্যার খবরে।

এলভিস প্রেসলির মৃত্যু রটে গেছে চরাচরে। চারখানায়
আড্ডা জমে, পপ সুরে মারফতী গান শুনে মাথা নাড়ে বিগত-যৌবন
ফেরিঅলা। অন্ধকারে তরুণ কবির চোখে পড়ে
অপ্সীরর স্তন,
হিজড়ের সুবজাভ গাল, নর্দমায় ভাসমান সুন্দরীর মৃতদেহ।
দ্যাখো দ্যাখো এ শহরে কী ঘর বানায় ওরা শূন্যের মাঝার।

আমিতো একাই থাকি রাত্রিদিন। এখন কোথায় তুমি কোন
সভ্যতার আলো
চোখে নিয়ে আছো শূন্য বারান্দায়? সৌন্দর্য তোমার
সাথে আছে, তোমাতেই মিশে আছে। পাথরের সিঁড়ি
ভেঙ্গে ভেঙ্গে হেঁটে
বহুদূর চলে গেছে বুঝি? একজন কবি তার ব্যাকুলতা,
শব্দপ্রেম রেখেছিলে। তোমার কোমল অঞ্জলিতে-
মনে পড়ে নাকি?
থেমে-যাওয়া ক্যাসেটের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে জানালার
বাইরে কি যেন দেখানোর ছলে আমার আপন
হৃদয়ের অন্তলীন গুহার আঁধার কত সজীব জাগ্রত
দেখে নিতে চেয়েছিলে? অদৃশ্য হরিণ কাঁদে তোমার বাগানে
গভীর রাত্তিরে ঘুরে ঘুরে।

বারান্দায়, ছাদে আর সিঁড়িতে অস্পষ্ট পদধ্বনি, বাড়িটার
দু’চোখে পা ঠোকে ঘোড়া, কার জেল্লাদার পোশাকের
স্পর্শ লাগে তার গালে, বুকে বিদ্ধ কামার্ত নিশান।
বিপ্লবের আগুনের মতো কিছু চক্রাকারে ঘোরে চতুর্দিকে,
কেউ হাত সেঁকে, কেউ পুড়ে ছারখার হয়। হৃদয় কী ঘোরে
সময় আবৃত্তি করে, প্রতীক্ষায় থাকে, জ্বলে আবেগকম্পিত,
স্মৃতিভারাতুর কোনো গজলের মতো।
আমি তো একাই থাকি রাত্রিদিন। কখনো সখনো লোকজন
থাকে বটে আশেপাশে কিংবা
চেনা মহলের চৌহদ্দিতে বসবাস করতেই হয়, কণ্ঠ
মেলাতেই হয় সংসারের ঐকতানে, তবু আমি দৈনন্দিন
কলরবে অকস্মাৎ কেমন রহস্যময় হয়ে উঠি নিজেরই অজ্ঞাতে,
কেমন নিশ্চুপ
এবং প্রকৃত বিপ্লবীর মতো জেগে থাকি নিজস্ব ভূগর্ভে
উদাসীন, একা।

(প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *