Atmajaibanik আত্মজৈবনিক– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

আত্মজৈবনিক
– শামসুর রাহমান

যুদ্ধবাজ সাইরেনে উচ্চকিত কৈশোর আমার
গলির বিধ্বস্ত ঘরে। গুলির শব্দের প্রতীক্ষায়
কেটেছে ভুতুড়ে রাত্রি অন্ধকারে এবং তামার
মতো দিন খাকির প্রতাপে কাঁপে শান্তির ভিক্ষায়।

যৌবন দুর্ভিক্ষ-বিদ্ধ, দাঙ্গাহাঙ্গামায় ভাঙে দেশ,
এদিকে নেতার কণ্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি
ভাষা খোঁজে। আদর্শের ভরাডুবি, মহাযুদ্ধ শেষ,
মঞ্চ তৈরিঃ কে হবে নায়ক তবে? করি কার স্তুতি?

সগৌরবে ঢাক-ঢোল বাজালো সে ধ্বংসের উৎসবে
যারা তারা কেউ পেলে শিরোপ, কেউবা পতনের
ঝাঁ-ঝাঁ স্মৃতি; বহু মাঠ গেলো ভরে নামহীন শবে।
পচা মাংস দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বেশ্যার স্তনের
উষ্ণতার মনস্তাপ মাখে যে- লোকটা মগজেই
ঘোরে তার শবাধার, একগাছি দড়ি কিংবা ক্ষুর-
যা-কিছু হননপ্রিয়, যা-কিছু অত্যন্ত সহজেই
জীবনকে করে তোলে অর্থহীন জীর্ণ আস্তাকুঁড়।

চতুর বক্তৃতাবলী, প্রচারণা, সংঘের ধূর্তামি
ছাড়া কল্কে পাওয়া ভার! বুক বেঁধে নির্বোধ সাহসে
বিবর্ণ স্যাণ্ডেল পায়ে ঘুরেছি ধুলোয় রোজ আমিঃ
হা-ঘরে বন্ধুর খোঁজে কতদিন বেড়িয়েছি চষে
সারাটা শহর। অন্ধকারে কতো আনোরারা, বামী
ইতস্তত গেছে ডুবে- দেখেছি স্বচক্ষে আর কষে
দিয়েছি বিড়িতে টান একাকিত্বে যখন তখন।
স্বরণের আঠা দিয়ে হতাশ প্রেমের জলছবি
সেঁটেছি সত্তার ফ্রেমে। মধ্যপথে কেড়েছেন মন
রবীন্দ্রঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি।

কখনো শুনিনি পার্কে বসে হরিণের ডাক কিংবা
পরীর আশ্চর্য স্তন আনেনি মোহের জ্যোৎস্না চোখে,
জানালার শক্ত শিকে কোনোদিন। নিজেকে প্রতিভা-
বান ভেবে ঘেঁটেছি নন্দনতত্ত্ব, যা বলুক লোকে

স্বপ্নে শুধু হাঁসের ঝাপট দেখি কশাইখানায়ঃ
মনে হয় স্ট্রেচারের ক্যানভাসে পড়ে আছি একা,
কানে আসে কানাঘুষো, যেতে যেতে কে যেন জানায়ঃ
এইতো বেজেছে ঘণ্টা, হবে না কখনো আর দেখা।

বতিচেলী নারী নয়, মাতিসের রমণীর মতো
তেমন কাউকে নয়, যে-হোক সে-হোক নারীকেই
পাশে নিয়ে রাস্তায় হাঁটবো ভেবে সুখে অবিরত
হঠাৎ নিজেরাই পায়ে মেরেছি কুড়াল। মেরে খেই

হারিয়েছি জীবনের। মধ্যে মধ্যে ইচ্ছে হয় বলি
জীবন, থামোহে বাপু, শুনেছি তোমার বাচালতা
অনর্গল বহুদিন; এবার দিয়েছি জলাজ্ঞলি
মেরুদণ্ডহীন, ক্লীব আশাকে তোমার। যে ব্যর্থতা
আমাকে শাসায় নিত্য, আমি তারই অগ্নিকুণ্ডে জ্বলি।
তোমরা আসবে কেউ? খোঁজো যারা ক্ষিপ্র সার্থকতা!

যেহেতু যথেষ্ট নই ভদ্রলোক তাই জবুথবু
সমাজের মোড়লেরা যথারীতি করেছে বিদায়
ওহে অর্ধচন্দ্র দিয়ে। কোনোমতে সামলে নিয়ে তবু
প্রতিবাদ করবো কি করবো না, পড়েছি দ্বিধায়।

একদিন নিত্যসঙ্গী ছিল যারা তারা ডানে বামে
সরে পড়ে, আমি শুধু যাইনে কোথাও। চোখে ভ্রম,
আরেক যুদ্ধের ছায়া যৌবনের অপরাহ্ণে নামে
এবং জীবন জানি সারাক্ষণ সিসিফস-শ্রম।

(বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *