Amar E Shohorer Chokh আমার এ শহরের চোখ– শামসুর রাহমান Shamsur Rahman

Rate this Book

আমার এ শহরের চোখ
– শামসুর রাহমান

কোথাও ছিল না বৃষ্টিধারা, এ আমার শহরের
অশ্রুপাত; কেঁদে কেঁদে শহরের চোখ দু’টো লাল
আর অতিশয় ফোলা কেন
পারে না বলতে কেউ। কেন তার বুক ঠেলে এত
কান্না ওঠে প্রহরে প্রহতে
এ শহর নিজেও জানে না। আমি শুধু কবিতায়
কিছু অশ্রুকণা জড়ো করি অবেলায় ছোট ঘরে
অরক্ষিত, একা।

কখন জানালা দিয়ে প্রজাপতি ঘরে ঢুকে পড়ে
ফুলের পাপড়ির মতো, বসে
আমার গ্রীবায়, যেন সে অশ্রয়প্রার্থী, অসহায়,
নিজেকে বাঁচাতে চায় নিপীড়ন থেকে। এখন সে
কম্পমান, যেমন চারার পাতা দুরন্ত হাওয়ায়।
আমি কি পারব দিতে ওকে বরাভয়?
লুকিয়ে রাখব তাকে স্বপ্নের ভেতর,
আমার নিমগ্ন কবিতার ক্যামোফ্লোজে?

যা বলি বিশ্বাস করো-ফুরফুরে চড়ুই অথবা
মাছরাঙা, নিভৃত কোকিল,
দ্যুতিময় মাছ, বৃক্ষলতা, ফলমূল, ফুল
এখন কেউই নিরাপদ নয় আর।

যখন বয়স ছিল উনিশ কি বিশ,
তখন থেকেই আমি লিখছি কবিতা
প্রায় ভূতগ্রস্ততায়। কত রাত শব্দের সন্ধানে
প্রত্যুষের কাকের আওয়াজে
চমকে উঠেছি, আধা বোঁজা চোখে স্বপ্নের নগ্নতা
লেপ্টে গেছে কতবার। আমার প্রতিটি
কবিতাকে ওরা সারিবদ্ধ কয়েদীর মতো দাঁড়
করিয়ে ফুলেটবিদ্ধ করে আজ গোধূলিবেলায়
আমার আপন ভালবাসা
সজীব ফলের মতো গহন সবুজ পত্রালিতে
আচ্ছাদিত। কখনও কখনও তার চোখে
চোখ রেখে মনে হয়, এই রূপ কোথাও দেখিনি
কোনো কালে; এমনকি আমি তার চলে যাওয়ার ছায়ার
সঙ্গে প্রেমে ম’জে আছি। ‘এইতো এসেছি
ব’লে সে যখন দাঁড়ায় সম্মুখে, তার দিকে
ঘাতকের হাত প্রসারিত দেখে ভয়ে কেঁপে উঠি।

ক’দিন বা আছি আর? তারপর অনন্তের পথে
ছায়া হ’য়ে হেঁটে যাওয়া, হেঁটে যাওয়া, শুধু হেঁটে যাওয়া।
অথচ এখনই বন্ধ দরজাটা ঠেলে
ভেতরে আসতে চায় হন্তারক নরকের কুকুরের মতো
দাঁত নখ ভেজাতে শোণিতে। আমার এ শহরের
চোখ ভরা রক্তাশ্রুতে রাত্রিদিন; কে দেবে মুছিয়ে
তার চোখ চুমোর জ্যোৎস্নায়, কে সে? বলতে পারি না।
তার পদধ্বনি বাজল কি আজ দিগন্তের বুকে
গুণীর তানের মতো? আমার শঙ্কিত কাঁধে দৃঢ়তা অর্পণ
ক’রে বলে উঠবে কি, এ শহরে মৃত্যুর উৎসব বাঁচবে না?

শহর ঘুমিয়ে ছিল পরিশ্রান্ত শ্রমিকের মতো।
কবি তার সদ্য লেখা কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা জিভে
খেলিয়ে খেলিয়ে বিছানায় গেছে, স্বপ্নের ভেতর
নদীর কিনারে ব’সে গোণে ক’টি সারস নেমেছে
বালুচরে। নতুন কবিতা তাকে দেয় না ঘুমোতে
মাঝে মাঝে, দপ দপ করে চোখে, শিরায় শিরায়।

অকস্মাৎ ২৪টি ঘন্টা বেজে ওঠে দেশ জুড়ে,
কবি শোনে ছন্দোময় ভোরে লেখার টেবিলে ব’সে।
সাহস শব্দটি আজ বিশাল হরফে লেখা হ’ল
সারা দেশে, স্বাধীনতা ২৪টি অনিন্দ্য গোলাপ
হ’য়ে ফোটে জনতার হৃদয়ে এবং খলখল
অন্ধকার কেটে চলে নিরন্তর আলোর তরণী।

ঘন্টাধ্বনি প্রতিবাদী কবিতার মতো জাগরণী
মহামন্ত্র শোনায়, নিমিষে শহরে চোখ থেকে
ঘুম মুছে যায়, চেয়ে দেখে ২৪টি মুখ তাজা
ভোরবেলাকার মতো। নদীতে পা ধুয়ে কবি হেঁটে
যায় কিয়দ্দূরে নিতে আলোকিত প্রকৃত নিশ্বাস,
২৪ সংখ্যাটি যে ইন্দ্রজালে হ’লে ইতিহাস।

(হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *