আবাসিক
– শামসুর রাহমান
কোনো ঘুমন্ত রূপসীর স্মিত হাসির মতো
এই বিকেল। হাওয়া এক পাল
হরিণের চাঞ্চল্য। সুসজ্জিত মঞ্চে
শোভা পাচ্ছে সেমিনারের সুলেখা শিরোনাম।
নগরের আবাসিক সমস্যা’। সভাকক্ষ
আস্তে-আস্তে ভ’রে উঠলো শ্রোতায়,
যেমন উৎসবের দিন কোনো কোনো বিরাট ঘর
ছেয়ে যায় ফুলের স্তবকে। মঞ্চ
সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি
এবং বক্তাবৃন্দ; কেউ-কেউ প্রৌঢ়, কেউবা যুবা।
মঞ্চস্থিত টেবিলে যুগল সৌখিন ফুলদানি আর এক গ্লাশ
টলটলে পানি। মঞ্চে উপবিষ্ট যাঁরা,
তাঁদের অধিকাংশের নিজস্ব ঘরবাড়ি আছে,
কারো-কারো একাধিক; একজন কি দু’জনের কোনো
বাড়ি আছে, অধিকাংশই ভাড়াটে বাড়ির বাশিন্দা;
কেউ কেউ থাকেন মেসবাড়িতে।
নগরের আবাসিক সমস্যা বিষয়ে
বক্তারা একে-একে বক্তৃতা দিলেন সকলেই। বক্তব্য তাঁদের
শাঁসালো, যুক্তিশাণিত। মঞ্চে ক্ষনে ক্ষণে
টিভি ক্যামেরার চমক আর ঠমক। ক্যামেরাম্যান আর
স্টাফ ফটোগ্রাফারদের
হঠাৎ আলোর ঝলকানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সভাকক্ষ বারংবার
ঝলমলিয়ে উঠলো অজস্র কথার ফুলকিতে। কেউ কেউ
পাঠ করলেন দীর্ঘ প্রবন্ধ, তত্ত্বে তথ্যে ভুরভুরে।
প্রবন্ধ-পাঠকালীন কোনো-কোনো মুহূর্তে কেউ আড়চোখে
দেখে নিলেন শ্রোতাদের মুখমন্ডলে
ভাষণের প্রতিক্রিয়া; কেউবা হাততালির স্থায়িত্বের মাপকাঠিতে
নিজের জনপ্রিয়তা করলেন পরখ। তাদের
সুভাষিবলীর মুখে পড়লো ফুলচন্দন।
প্রধান অতিথি যখন ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে
আসন ছেড়ে দাঁড়ালেন,
এগিয়ে গেলেন মাইক্রোফোনের দিকে, তখনই
বলা-কওয়া নেই, হঠাৎ একজন বালক
সবার অলক্ষ্যে শূন্য একটি চেয়ারে এসে
ব’সে পড়লো আনাহূত বিশেষ অতিথির মতো।
তার পরনে ছেঁড়া শার্ট, জন্মের পর যতোগুলো বছর
সে পাড়ি দিয়ে এসেছে, ততো বিচিত্র তালি তার
ময়লা হাফপ্যান্টে চুল উসকো-খুসকো। রাস্তার ধারে
ধুলোবালির ঘর বানাচ্ছিলো। সে রাস্তাই
নিবাস তার; দিনে ঘুরে বেড়ায় এক রাস্তা থেকে
অন্য রাস্তায় নির্বাসিত নাবালক রাজার মতো,
কুড়ায় বাতিল কাগজ। কারো
বাগানের বেড়া ডিঙিয়ে তোলে না গোলাপ
বাজখাঁই গলার ভয়ে। রাতে ঘুমায়
ফুটপাথে, দোকানের বন্ধ দরজার কাছে, কিংবা
টিনশেডের আশেপাশে। কখনো-কখনো স্বপ্নে
সে প্রবেশ করে অভ্রের তৈরি গীতময় এক অট্রলিকায়।
এখন সে আচমকা ঢুকে পড়েছে কৌতূহল বশে
এই সভাকক্ষে, প্রবেশাধিকারের
প্রশ্নটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। নাকি সে
নগরের আবাসিক সমস্যা বিষয়ক সেমিনারে
যাচাই করতে এসেছে, এই যে সাত বছর আগে
ঘুঁটেকুড়ানী এক নারীর অন্তর্গত লতাগুল্ম ছিঁড়ে
সভ্যতার উগরে-দেয়া উচ্ছিষ্ট হিশেবে
সে চলে এসেছে পৃথিবীতে, এ-ঘটনা কতোটা যুক্তিসঙ্গত
এবং সমীচীন!
(ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)