একটি সুখপাঠ্য বইয়ের সংজ্ঞা কী? সুখপাঠ্য বই হলো সুনিপুণ ভাবে লিখিত যে বই পড়ে কেবল তৃপ্তিই পাওয়া যায় না বরং এ-র আবেশ বহুকালব্যাপী থাকে। এই বইটি ঠিক সে প্রকৃতিরই বই। মজার বিষয় হলো আপনি লেখকের সাথে সব বিষয়ে একমত পোষণ করবেন না – সব বিষয়ে একমত পোষণ করা জরুরিও না, কিন্তু আপনি লেখকের মতামতকে ফেলে দিতে পারবেন না। কিছু মতামত গলায় আটকে যাবে কারণ আপনি না পারবেন ফেলতে, না পারবেন গিলতে। লেখকের সার্থকতা এখানেই।
যেহেতু আপনি না পারবেন গিলতে, না পারবেন ফেলতে তাই এই বইটি স্বভাবতই আপনার ভাবনার জগতকে বারংবার আঘাত করবে। আঘাত করা বই-ও আবার সুখপাঠ্য হয় না-কি! বড়ই বিচিত্র বই! আর কেন-ই বা আঘাত করবে? কি-ই বা আছে এই বইয়ে? এই বই হতে আমার পছন্দের কিছু বিষয় তুলে ধরলেই হয়তো উত্তর পেয়ে যাবেন।
১. একদিন আমাদের আকাশ আমাদের মাথার উপর টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে লাগলো। কিন্তু আমাদের রাজা একটিবারও ভাবলেন না-আকাশের একটি ভাঙ্গা টুকরো তার মাথায়ও পড়তে পারে।
২. মানুষ বাঁচে সময়কে খুন করে। কেউ মারা গেছে, এর অর্থ হলো তার হাতে আর খুন করার মতো সময় অবশিষ্ট নেই। কারো জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে, এটি দিয়ে বুঝায় – লোকটি সময়কে খুব বেশি হত্যা করতে পারছে না। এজন্য সফলতাকে আমি বলি সময়ের লাশ, যেরকম ঘিকে বলি দুধের লাশ।
৩. ভুঁড়ি হলো একজনের শরীরে বেড়ে ওঠা আরেকজনের মাংস। কোথাও কেউ না কেউ না খেয়ে থাকে বলেই জন্ম হয় ভুঁড়ির। পড়াশোনা জানা বেকার ছেলেরা একটি ভালো ভুঁড়ির অভাবে বিয়ের স্বাদ নিতে পারছে না। এ জন্য তরুণেরা এখন রাত-দিন প্রার্থনা করছে “হে আল্লাহ্, আমাদেরকে একটি বিসিএস ভুঁড়ি দাও।”
৪. ব্যাঙ যেখানেই বাস করে সেখানেই কাদা তৈরি করে। আমরাও তাই করি। আমাদের জাতীয় ক্রিয়াকর্মের নাম-কাদা ছোঁড়াছুড়ি। কারো গায়ে ছুঁড়ে মারার মত কাদা না পেলে আমরা পেট থেকে কাদা বের করে ছুঁড়ে মারি।
৫. প্রভু ভক্তিতে কুকুরদের এক সময় খুব সুনাম থাকলেও সম্প্রতি মানুষেরা তাদের এ সুনাম কেড়ে নিয়েছে। কুকুরেরা লক্ষ্য করেছে পৃথিবীর কিছু কিছু এলাকায় মানুষ প্রভুভক্তিতে কুকুরদেরও ছাড়িয়ে গেছে।
৬. বাংলাদেশে নারী ও গাভীর পর যে প্রাণীটি এখন সবচেয়ে নিরীহ জীবন যাপন করছে, তার নাম শিক্ষক।
৭. এ দেশে কারও সাথে তর্ক করা মোটেও নিরাপদ নয়। এখানে রোগী সব সময় ডাক্তারের চরিত্রে অভিময় করে।
৮. মানুষের জীবনে সমাজের ভূমিকা কনডমের মত। যা কিছু সৃষ্টিশীল তার সবকিছু আটকে দেয়াই সমাজের কাজ। সমাজ জানে তার ভবিষ্যৎ অনাসৃষ্টিতে। সৃষ্টি প্রিয় শুক্রাণু তার শত্রু। যেখানেই মাথা তুলে দাঁড়ায় সামান্য সৃষ্টি, সেখানেই সমাজ হাজির হয় বাধার বৃষ্টি নিয়ে। সমাজের কালো পর্দা ভেদ করে মানুষ এখন আর আকাশের দিকে তাকাতে পারেনা। তাকে হাঁটতে হয় সারাক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে চেয়ে।
৯. সম্মান একটি সামাজিক রোগ। কোন সমাজে ভালোবাসা কমে গেলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। কোন ব্যক্তি যখন দেখেন যে, তাকে ভালোবাসার কোনো কারণ মানুষের নেই তখন তিনি সম্মান দাবি করেন। সম্মান হলো ভালোবাসার ঘাটতি পূরণের একটি কৌশলমাত্র। এ কৌশল বাস্তবায়নের মানুষ প্রথমে আশ্রয় নেয় ক্ষমতার।
১০. মানুষ যতটা না বুদ্ধিমান তার চেয়েও বিশ্বাসী। যদি বিশ্বাসের পেছনে সে ভালো কোন কারণ খুঁজে না পায়, তাহলে সে নিজেই কিছু কারণ উদ্ভাবন করে ফেলে। খুব বিপদে না পড়লে সে বুদ্ধিকে বিশ্বাসের উপর স্থান দিতে চায় না। কোন কিছু কারণ অনুসন্ধান একটি পরিশ্রমের কাজ, যা মানুষ সাধারণত করতে চায় না। এর চেয়ে বানোয়াট কোন কুসংস্কারের কাঁধেই দায় চাপানো ভালো।
এই বিষয়গুলো ব্যাখা করলে পোস্ট আরও বড় হয়ে যাবে। বুদ্ধিমান পাঠক এই উক্তিগুলো পড়লেই ধরতে পারবে আসলে কোন কোন বিষয়গুলো এখানে মেটাফোর হিসেবে ধরা হয়েছে। বাকিসব বিষয় জানতে হলে বইটি পড়তে হবে। এগুলোর বাইরে “শিক্ষা” এবং “ধর্ষণের সাথে নারীর পোশাকের সম্পর্ক” নিয়ে বেশ গোছালো বর্ণনা আছে এই বইয়ে। ছাত্রদের বেতন দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা আমি হয় বুঝিনি, নয়তো আমার ভালো লাগেনি। এই বিষয়ে আমার দ্বিমত আছে। বাকিসব দিক বিবেচনা করলে এ বছর এখন পর্যন্ত আমার পড়া সেরা বই। এটি। তাই সুখপাঠ্য এই বইটি পড়তে উৎসাহিত করবো।
বই : আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র
লেখক : মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
P.R : 4/5 PDF Download Link