পত্র
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নৌকাযাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিয়া লিখিত
সুহৃদ্বর শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন স্থলচরবরেষু
জলে বাসা বেঁধেছিলেম , ডাঙায় বড়ো কিচিমিচি ।
সবাই গলা জাহির করে , চেঁচায় কেবল মিছিমিছি ।
সস্তা লেখক কোকিয়ে মরে , ঢাক নিয়ে সে খালি পিটোয় ,
ভদ্রলোকের গায়ে পড়ে কলম নেড়ে কালি ছিটোয় ।
এখানে যে বাস করা দায় ভনভনানির বাজারে ,
প্রাণের মধ্যে গুলিয়ে উঠে হট্টগোলের মাঝারে ।
কানে যখন তালা ধরে , উঠি যখন হাঁপিয়ে
কোথায় পালাই , কোথায় পালাই — জলে পড়ি ঝাঁপিয়ে
গঙ্গাপ্রাপ্তির আশা করে গঙ্গাযাত্রা করেছিলেম ।
তোমাদের না বলে কয়ে আস্তে আস্তে সরেছিলেম ।
দুনিয়ার এ মজলিসেতে এসেছিলেম গান শুনতে ,
আপন মনে গুনগুনিয়ে রাগ – রাগিণীর জাল বুনতে ।
গান শোনে সে কাহার সাধ্যি , ছোঁড়াগুলো বাজায় বাদ্যি ,
বিদ্যেখানা ফাটিয়ে ফেলে থাকে তারা তুলো ধুনতে ।
ডেকে বলে , হেঁকে বলে , ভঙ্গি করে বেঁকে বলে —
‘‘ আমার কথা শোনো সবাই , গান শোনো আর নাই শোনো।
গান যে কাকে বলে সেইটে বুঝিয়ে দেব , তাই শোনে । ”
টীকে করেন ব্যখ্যা করেন , জেঁকে ওঠে বক্তিমে —
কে দেখে তার হাত – পা নাড়া , চক্ষু দুটোর রক্তিমে !
চন্দ্রসূর্য জ্বলছে মিছে আকাশখানার চালাতে —
তিনি বলেন , ‘‘ আমিই আছি জ্বলতে এবং জ্বালাতে । ”’
কুঞ্জবনের তানপুরোতে সুর বেঁধেছে বসন্ত ,
সেটা শুনে নাড়েন কর্ণ , হয় নাকো তাঁর পছন্দ ।
তাঁরি সুরে গাক – না সবাই টপ্পা খেয়াল ধুরবোধ —
গায় না যে কেউ , আসল কথা নাইকো কারো সুর – বোধ !
কাগজওয়ালা সারি সারি নাড়ছে কাগজ হাতে নিয়ে —
বাঙলা থেকে শান্তি বিদায় তিনশো কুলোর বাতাস দিয়ে ।
কাগজ দিয়ে নৌকা বানায় বেকার যত ছেলেপিলে ,
কর্ণ ধরে পার করবেন দু – এক পয়সা খেয়া দিলে ।
সস্তা শুনে ছুটে আসে যত দীর্ঘকর্ণগুলো —
বঙ্গদেশের চতুর্দিকে তাই উড়ছে এত ধুলো ।
খুদে খুদে ‘আর্য’ গুলো ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে ,
ছুঁচোলো সব জিবের ডগা কাঁটার মতো পায়ে ফোটে ।
তাঁরা বলেন , ‘‘ আমিই কল্কি” — গাঁজার কল্কি হবে বুঝি !
অবতারে ভরে গেল যত রাজ্যের গলিঘুঁজি ।
পাড়ার এমন কত আছে কত কব তার !
বঙ্গদেশে মেলাই এল বরা ‘- অবতার ।
দাঁতের জোরে হিন্দুশাস্ত্র তুলবে তারা পাঁকের থেকে ,
দাঁতকপাটি লাগে তাদের দাঁত – খিঁচুনির ভঙ্গি দেখে ।
আগাগোড়াই মিথ্যে কথা , মিথ্যেবাদীর কোলাহল ,
জিব নাচিয়ে বেড়ায় যত জিহ্বাওয়ালা সঙের দল ।
বাক্যবন্যা ফেনিয়ে আসে , ভাসিয়ে নে যায় তোড়ে —
কোনোক্রমে রক্ষে পেলাম মা – গঙ্গারই ক্রোড়ে ।
হেথায় কিবা শান্তি – ঢালা কুলুকুলু তান !
সাগর – পানে বহন করে গিরিরাজের গান ।
ধীরি ধীরি বাতাসটি দেয় জলের গায়ে কাঁটা ।
আকাশেতে আলো – আঁধার খেলে জোয়ারভাঁটা ।
তীরে তীরে গাছের সারি পল্লবেরই ঢেউ ।
সারা দিবস হেলে দোলে , দেখে না তো কেউ ।
পূর্বতীরে তরুশিরে অরুণ হেসে চায় —
পশ্চিমেতে কুঞ্জমাঝে সন্ধ্যা নেমে যায় ।
তীরে ওঠে শঙ্খধ্বনি , ধীরে আসে কানে ,
সন্ধ্যাতারা চেয়ে থাকে ধরণীর পানে ।
ঝাউবনের আড়ালেতে চাঁদ ওঠে ধীরে ,
ফোটে সন্ধ্যাদীপগুলি অন্ধকার তীরে ।
এই শান্তি – সলিলেতে দিয়েছিলেম ডুব ,
হট্টগোলটা ভুলেছিলেম , সুখে ছিলেম খুব ।
জান তো ভাই আমি হচ্ছি জলচরের জাত ,
আপন মনে সাঁতরে বেড়াই — ভাসি যে দিনরাত ।
রোদ পোহাতে ডাঙায় উঠি , হাওয়াটি খাই চোখ বুজে ,
ভয়ে ভয়ে কাছে এগোই তেমন তেমন লোক বুঝে ।
গতিক মন্দ দেখলে আবার ডুবি অগাধ জলে ,
এমনি করেই দিনটা কাটাই লুকোচুরির ছলে ।
তুমি কেন ছিপ ফেলেছ শুকনো ডাঙায় বসে ?
বুকের কাছে বিদ্ধ করে টান মেরেছ কষে ।
আমি তোমায় জলে টানি , তুমি ডাঙায় টানো —
অটল হয়ে বসে আছ , হার তো নাহি মানো ।
আমারি নয় হার হয়েছে , তোমারি নয় জিত —
খাবি খাচ্ছি ডাঙায় পড়ে হয়ে পড়ে চিত ।
আর কেন ভাই , ঘরে চলো ছিপ গুটিয়ে নাও ,
রবীন্দ্রনাথ পড়ল ধরা ঢাক পিটিয়ে দাও ।
(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)