Mrittur Pore মৃত্যুর পরে– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Rabindranath Tagore

Rate this Book

মৃত্যুর পরে
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজিকে হয়েছে শান্তি ,
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে ।
রাত্রিদিন ধুক্‌ধুক্‌
তরঙ্গিত দুঃখসুখ
থামিয়াছে বুকে ।
যত কিছু ভালোমন্দ
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
হয়ে যাক ছাই ।

গুঞ্জরি করুক তান
ধীরে ধীরে করো গান
বসিয়া শিয়রে ।
যদি কোথা থাকে লেশ
জীবনস্বপ্নের শেষ
তাও যাক মরে ।
তুলিয়া অঞ্চলখানি
মুখ- ‘ পরে দাও টানি ,
ঢেকে দাও দেহ ।
করুণ মরণ যথা
ঢাকিয়াছে সব ব্যথা
সকল সন্দেহ ।

বিশ্বের আলোক যত
দিগ্‌বিদিকে অবিরত
যাইতেছে বয়ে ,
শুধু ওই আঁখি- ‘ পরে
নামে তাহা স্নেহভরে
অন্ধকার হয়ে ।
জগতের তন্ত্রীরাজি
দিনে উচ্চে উঠে বাজি ,
রাত্রে চুপে চুপে
সে শব্দ তাহার ‘ পরে
চুম্বনের মতো পড়ে
নীরবতারূপে ।

মিছে আনিয়াছ আজি
বসন্তকুসুমরাজি
দিতে উপহার ।
নীরবে আকুল চোখে
ফেলিতেছ বৃথা শোকে
নয়নাশ্রুধার ।
ছিলে যারা রোষভরে
বৃথা এতদিন পরে
করিছ মার্জনা ।
অসীম নিস্তব্ধ দেশে
চিররাত্রি পেয়েছে সে
অনন্ত সান্ত্বনা ।

গিয়েছে কি আছে বসে
জাগিল কি ঘুমাল সে
কে দিবে উত্তর ।
পৃথিবীর শ্রান্তি তারে
ত্যজিল কি একেবারে
জীবনের জ্বর!
এখনি কি দুঃখসুখে
কর্মপথ-অভিমুখে
চলেছে আবার ।
অস্তিত্বের চক্রতলে
একবার বাঁধা প ‘ লে
পায় কি নিস্তার ।

বসিয়া আপন দ্বারে
ভালোমন্দ বলো তারে
যাহা ইচ্ছা তাই ।
অনন্ত জনমমাঝে
গেছে সে অনন্ত কাজে ,
সে আর সে নাই ।
আর পরিচিত মুখে
তোমাদের দুখে সুখে
আসিবে না ফিরে ।
তবে তার কথা থাক্‌ ,
যে গেছে সে চলে যাক
বিস্মৃতির তীরে ।

জানি না কিসের তরে
যে যাহার কাজ করে
সংসারে আসিয়া ,
ভালোমন্দ শেষ করি
যায় জীর্ণ জন্মতরী
কোথায় ভাসিয়া ।
দিয়ে যায় যত যাহা
রাখো তাহা ফেলো তাহা
যা ইচ্ছা তোমার ।
সে তো নহে বেচাকেনা —
ফিরিবে না , ফেরাবে না
জন্ম-উপহার ।

কেন এই আনাগোনা ,
কেন মিছে দেখাশোনা
দু-দিনের তরে ,
কেন বুকভরা আশা ,
কেন এত ভালোবাসা
অন্তরে অন্তরে ,
আয়ু যার এতটুক ,
এত দুঃখ এত সুখ
কেন তার মাঝে ,
অকস্মাৎ এ সংসারে
কে বাঁধিয়া দিল তারে
শত লক্ষ কাজে —

হেথায় যে অসম্পূর্ণ ,
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত ,
কোথাও কি একবার
সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত ,
জীবনে যা প্রতিদিন
ছিল মিথ্যা অর্থহীন
ছিন্ন ছড়াছড়ি
মৃত্যু কি ভরিয়া সাজি
তারে গাঁথিয়াছে আজি
অর্থপূর্ণ করি —

হেথা যারে মনে হয়
শুধু বিফলতাময়
অনিত্য চঞ্চল
সেথায় কি চুপে চুপে
অপূর্ব নূতন রূপে
হয় সে সফল —
চিরকাল এই-সব
রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ-ওষ্ঠাধর ।
জন্মান্তের নবপ্রাতে
সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তর ।

সে হয়তো দেখিয়াছে
পড়ে যাহা ছিল পাছে
আজি তাহা আগে ,
ছোটো যাহা চিরদিন
ছিল অন্ধকারে লীন
বড়ো হয়ে জাগে ।
যেথায় ঘৃণার সাথে
মানুষ আপন হাতে
লেপিয়াছে কালি
নূতন নিয়মে সেথা
জ্যোতির্ময় উজ্জ্বলতা
কে দিয়াছে জ্বালি ।

কত শিক্ষা পৃথিবীর
খসে পড়ে জীর্ণচীর
জীবনের সনে ,
সংসারের লজ্জাভয়
নিমেষেতে দগ্ধ হয়
চিতাহুতাশনে ।
সকল অভ্যাস-ছাড়া
সর্ব-আবরণ-হারা
সদ্যশিশুসম
নগ্নমূর্তি মরণের
নিষ্কলঙ্ক চরণের
সম্মুখে প্রণমো ।

আপন মনের মতো
সংকীর্ণ বিচার যত
রেখে দাও আজ ।
ভুলে যাও কিছুক্ষণ
প্রত্যহের আয়োজন ,
সংসারের কাজ ।
আজি ক্ষণেকের তরে
বসি বাতায়ন- ‘ পরে
বাহিরেতে চাহো ।
অসীম আকাশ হতে
বহিয়া আসুক স্রোতে
বৃহৎ প্রবাহ ।

উঠিছে ঝিল্লির গান ,
তরুর মর্মরতান ,
নদীকলস্বর —
প্রহরের আনাগোনা
যেন রাত্রে যায় শোনা
আকাশের’পর ।
উঠিতেছে চরাচরে
অনাদি অনন্ত স্বরে
সংগীত উদার —
সে নিত্য-গানের সনে
মিশাইয়া লহো মনে
জীবন তাহার ।

ব্যাপিয়া সমস্ত বিশ্বে
দেখো তারে সর্বদৃশ্যে
বৃহৎ করিয়া ।
জীবনের ধূলি ধুয়ে
দেখো তারে দূরে থুয়ে
সম্মুখে ধরিয়া ।
পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে
ভাগ করি খণ্ডে খণ্ডে
মাপিয়ো না তারে ।
থাক্‌ তব ক্ষুদ্র মাপ
ক্ষুদ্র পুণ্য ক্ষুদ্র পাপ
সংসারের পারে ।

আজ বাদে কাল যারে
ভুলে যাবে একেবারে
পরের মতন
তারে লয়ে আজি কেন
বিচার-বিরোধ হেন ,
এত আলাপন ।
যে বিশ্ব কোলের’পরে
চিরদিবসের তরে
তুলে নিল তারে
তার মুখে শব্দ নাহি ,
প্রশান্ত সে আছে চাহি
ঢাকি আপনারে ।

বৃথা তারে প্রশ্ন করি ,
বৃথা তার পায়ে ধরি ,
বৃথা মরি কেঁদে ,
খুঁজে ফিরি অশ্রুজলে —
কোন্‌ অঞ্চলের তলে
নিয়েছে সে বেঁধে ।
ছুটিয়া মৃত্যুর পিছে ,
ফিরে নিতে চাহি মিছে ,
সে কি আমাদের ?
পলেক বিচ্ছেদে হায়
তখনি তো বুঝা যায়
সে যে অনন্তের ।

চক্ষের আড়ালে তাই
কত ভয় সংখ্যা নাই ,
সহস্র ভাবনা ।
মুহূর্ত মিলন হলে
টেনে নিই বুকে কোলে ,
অতৃপ্ত কামনা ।
পার্শ্বে বসে ধরি মুঠি ,
শব্দমাত্রে কেঁপে উঠি ,
চাহি চারিভিতে ,
অনন্তের ধনটিরে
আপনার বুক চিরে
চাহি লুকাইতে ।

হায় রে নির্বোধ নর ,
কোথা তোর আছে ঘর ,
কোথা তোর স্থান ।
শুধু তোর ওইটুকু
অতিশয় ক্ষুদ্র বুক
ভয়ে কম্পমান ।
ঊর্ধ্বে ওই দেখ্‌ চেয়ে
সমস্ত আকাশ ছেয়ে
অনন্তের দেশ —
সে যখন এক ধারে
লুকায়ে রাখিবে তারে
পাবি কি উদ্দেশ ?

ওই হেরো সীমাহারা
গগনেতে গ্রহতারা
অসংখ্য জগৎ ,
ওরি মাঝে পরিভ্রান্ত
হয়তো সে একা পান্থ
খুঁজিতেছে পথ ।
ওই দূর-দূরান্তরে
অজ্ঞাত ভুবন- ‘ পরে
কভু কোনোখানে
আর কি গো দেখা হবে ,
আর কি সে কথা কবে ,
কেহ নাহি জানে ।

যা হবার তাই হোক ,
ঘুচে যাক সর্ব শোক ,
সর্ব মরীচিকা ।
নিবে যাক চিরদিন
পরিশ্রান্ত পরিক্ষীণ
মর্তজন্মশিখা ।
সব তর্ক হোক শেষ ,
সব রাগ সব দ্বেষ ,
সকল বালাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
পুড়ে হোক ছাই ।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *