ইলেকট্রার গান
– শামসুর রাহমান
শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়
মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।
মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও;
নির্দয় স্মৃতি মিতালী পাতায় শত করোটির সাথে।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
সে কবে আমিও স্বপ্নের বনে তুলেছি গোলাপ,
শুনেছি কত যে প্রহরে প্রহরে বনদোয়েলের ডাক।
অবুঝ সে মেয়ে ক্রাইসোথেমিস্ আমার সঙ্গে
মেতেছে খেলায়, কখনো আমার বেণীতে দিয়েছে টানে।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
পিতৃভবনে শুনেছি অনেক চারণ্যের গাথা,
লায়ারের তারে হৃদয় বেজেছে সুদূর মদির সুরে।
একদা এখানে কত বিদূষক প্রসাদ কুড়িয়ে
হয়েছে ধন্য, প্রধান কক্ষ ফুলে ফুলে গেছে ছেয়ে।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
প্রজাপতি-খুশি ফেরারী এখন, বিষাদ আমাকে
করেছে দখল; কেমন বিরূপ কুয়াশা রেখেছে ঘিরে।
রক্তের ডাকে দিশেহারা আমি ঘুরি এলোমেলো,
আমার রাতের শয্যায় সুধুক কান্নার স্বাক্ষর।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
সেইদিন আজো জ্বলজ্বলে স্মৃতি, যেদিন মহান
বিজয়ী সে বীর দূর দেশ থেকে স্বদেশে এলেন ফিরে।
শুনেছি সেদিন জয়ঢাক আর জন-উল্লাস;
পথে-প্রান্তরে তাঁরই কীর্তন, তিনিই মুক্তিদূত।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে
গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধ্বসে।
বিদেশী মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,
নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।
নিহন জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
আড়ালে বিলাপ করি একা-একা, ক্ষতার্ত পিতা
তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ।
এমন কি, হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি
নিষিদ্ধ আজ; তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়!
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
মাথার ভেতরে ঝোড়ো মেঘ ওড়ে, আমি একাকিনী
পিতৃভবনে আমার কেবলি সোক পালনের পালা।
পিতৃহন্তা চারপাশে ঘোরে, গুপ্তচরের
চোখ সেঁটে থাকে আমার ওপর, আমি নিরুপায় ঘুরি।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
কখনো কখনো মাঝরাতে আমি জেগে উঠে শুনি
পায়ের শব্দ, আস্তাবলের ঘোড়ার আর্তনাদ।
শিকারী কুকুর ঘরের কপাট ঠ্যালে অবিরত,
আমার রক্তে দাঁত-নখ তার সিক্ত করতে চায়।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
যতদিন আমি এই পৃথিবীতে প্রত্যহ ভোরে
মেলবো দু’চোখ, দেখবো নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা,
যতদিন পাবো বাতাসের চুমো, দেখবো তরুণ
হরিণের লাফ, ততদিন আমি লালন করবো শোক।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
অন্ধের দেশে কে দেবে অভয়? ভাই পরবাসে;
যে নেবে আমার মহা দায়ভাগ, তেমন জীবনসঙ্গী কই?
কেমন ছাদের নিচে সহোদর ছেঁড়ে তার রুটি?
কোন্ প্রান্তরে ওড়াচ্ছে ধূলি ওরেস্টেসের ঘোড়া?
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
কান পেতে থাকি দীপ্র কণ্ঠ শোনার আশায়,
কাকের বাসায় ঈগলের গান কখনো যায় কি শোনা?
ক্রাইসোথেমিস, অবুঝ তন্বী, দূরে সরে থাকে,
বিকচোন্মুখ শরীরে এখন লায়ারের ঝংকার।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
আমার উপমা দাবানলে-পোড়া আর্ত হরিণী;
মৃতের মিছিল খুঁজি দিনরাত, আঁধারে লুকাই মুখ।
করতলে কত গোলাপ শুকায়, ঝরে জুঁই, বেলী;
আমার হৃদয়ে প্রতিশোধ জ্বলে রক্তজবার মতো।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
পারবো না আমি হানতে কখনো ক্রুর তরবারি,
যদিও ক্ষুব্ধ হৃদয় আমার, প্রতিশোধ জপমালা।
আত্মশুদ্ধি ঘাট যায় যদি দেখি সন্ধ্যায়
উড়ন্ত দু’টি সারস কী সুখে নদীটি পেরিয়ে যায়।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
যে যেমন খুশি যখন তখন বাজাবে আমাকে
নানা ঘটনায় ষড়জে নিখাদে, আমি কি তেমন বাঁশি?
কন্টকময় রক্ত পিপাসু পথে হাঁটি একা;
আমার গ্রীবায় এবং কণ্ঠে আগামীর নিশ্বাস।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।