কঙ্কালের সঙ্গে
– শামসুর রাহমান
আজকাল কী-যে হয়, বড়
ভুল করে ফেলি বারবার। চিঠি লিখে
খামে ভরবার পর ঠিকানা লিখতে গিয়ে কিছু
বাদ পড়ে যায়
অনিচ্ছাবশত আর সেই ভ্রম ভ্রমরের মতো
হুল ফোটাতেই থাকে। চিঠিখানি ডাকঘরে বেঘোরে ঘুমায়।
বয়সকে দোষী ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা
দিই বটে, তবু এই বেয়াড়া মনের হঠকারি আচরণে
ক্রদ্ধ হয়ে আমারই মাথার চুল ছিঁড়ি
আর কষে চড় দিই টেবিলের গালে। অকস্মাৎ
নিকটে ঝিমিয়ে-থাকা অসমাপ্ত কবিতা আমার
হায়, ভীতত্রস্ত হয়ে দৃষ্টিপাত করে ডানে, বামে।
তা হ’লে আমি কি খাতা বন্ধ করে রাখবো সর্বদা ?
কলমের মুখে এঁকে দেবো
খিল যতদিন বেঁচে থাকি ? ‘কেন তুমি এই মতো
ভাবনাকে আজকাল চলেছো প্রশ্রয় দিয়ে ?’- নিজেকে সওয়াল
করি; ‘মন থেকে ঝেড়ে ফেলে শুধু স্বাভাবিক জীবনের পথে
হেঁটে ফের তুখোড় আড্ডায় ঝেড়ে ফেলো ক্লান্তির কুয়াশা।‘
অথচ আমাকে নানা উদ্ভট দৃশ্যের ছায়াছবি
কেবলই দেখায় ভয়। ঘুমোতে গেলেই
কঙ্কালেরা আমার শয্যার পাশে এসে
দাঁড়ায় অথবা বসে। নিঃশব্দ হাসির তোড়ে ভাসায় আমাকে!
কাদের ভগ্নাংশ এরা? কোন্ দশক অথবা শতকের ধুলো
ঝেড়েঝুড়ে এসেছে এখানে? দাঁতহারা, শব্দহারা
হাসি যাচ্ছে দেখা মুখমণ্ডলে ওদের। কঙ্কালের
হাসি কি আমাকে কোনও পরমার্থ বোঝাবার চেষ্টা
করছে নির্জন ঘরে? পরমুহূর্তেই ওরা ঘরের রেলিং-এ
ঝুলে পড়ে, যেন কোনও ঘৃণ্য অপরাধের আসামি।
আচমকা নিজেকেই সেই কঙ্কালের মতো
মনে হয় আর আমি শুয়ে আছি যেন কোনও
পুরনো কবরে; নানা কীট শরীরের মাংসহীন,
ক্ষয়া হাড়ে হেঁটে হেঁটে ভীষণ বিরক্ত, ক্রুদ্ধ খুব! সেই দৃশ্য
থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে করে ভারী
ক্লান্ত হয়ে পড়ি, নখ দিয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটি আঁচড়াতে থাকি।
(গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ)