পারফিউম এবং আউট অফ দ্য ডার্ক বই দুটি এক টিকিটে দুই ছবি’র মত

5/5 - (6 votes)

এক টিকিটে দুই ছবি’র মত, নট ফর সেল ক্লাব এক মলাটে দুই বই এনেছে।

সেবা প্রকাশণীর ‘দুটি বই একত্রে’ অনেক দেখা যায়। তবে নট ফর সেল ক্লাবের এই কালেকশনে বই দুটো একে অপরের উল্টো। এদের প্রচ্ছদ ও আলাদা। এই দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এটা।

দুইটার ই রিভিউ করার চেষ্টা করছি।

পারফিউম

ফরাসী সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো ( ১৮০২-১৮৮৫) এর উপন্যাস গুলাতে বেশ কিছু সুপারম্যান দেখা যায়। এরা জন্মগতভাবে রক্ত মাংসের মানুষই, কিন্তু তাদের স্পেশাল কোনো একটা স্কিল থাকে কিংবা তাদের কাজকর্মে তারা একদম সুপারম্যান এর মত হয়ে যায়। যেসব কাজ নরমাল মানুষ করতে পারে না, এরা সেইসব কাজ করে ফেলে।

দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নটরডেম এর পঙ্গু ঘন্টাবাদক কাসিমোডো, কিংবা লা মিজারেবল এর জা ভালজা কে দেখে আমরা বিস্মিত হই। ভাবি, মানুষের পক্ষে কত কি করা সম্ভব!

প্যাট্রিক সাসকিন্ড এর পারফিউম বইতেও প্রায় একই ধরনের একজন সুপারম্যান কে দেখা যায়। গ্রেনয়, জন্মগতভাবে যার নাক্কটা বেশি সেন্সেটিভ। কুকুর বেড়াল বা অন্যান্য পশুদের মত, সে অনেক দূর থেকে গন্ধ শুকতে পারে। বিভিন্ন গন্ধের পার্থক্য ধরতে পারে। এই বিশেষ নাককে কাজে লাগিয়ে সে বিভিন্ন সুগন্ধী বস্তু মিশিয়ে নতুন পারফিউম তৈরিও করতে পারে।

এই সেন্সেটিভ অঙ্গ কাজে লাগিয়েই সে জীবনে শাইন করছিল। তার জন্ম হয়েছিল বেশ নিচু সমাজে, কিন্তু কাজের মাধ্যমেই সমাজের বেশ উচু জায়গায় পৌছে যাচ্ছিল। তবে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সেইরকম কিছু ছিল না। ( এইখানেই এসে পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য আসলে কি?)

গল্পের নায়ক, গ্রেনয় যা করে, তা হলে, জীবনের সব সম্পদ, সব অপরচুনিটি, সব ঝুকি দিয়ে সে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পারফিউম তৈরি করে। এই পারফিউম বানানোর জন্য সে আইনের ভেতরের এবং বাইরের ও অনেক কাজ করে ফেলে। সবশেষে, সেই পারফিউম টা ইউজ করে একটা নির্দিষ্ট মব কে কয়েক ঘন্টার জন্য স্বর্গের অনুভূতি দেয়। স্বর্গে গিয়ে মানুষের যা যা করার কথা, ওই নির্দিষ্ট পারফিউমের গন্ধ পেয়ে কয়েক ঘন্টা ওই মানুষরা সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে সেই স্বর্গীয় আনন্দে-উতসবে মেতে উঠেছিল।

কিন্তু এরপর গ্রেনয় কি করবে? ( আবার ও সেই দার্শনিক চিন্তা মাথায় আসে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি!)

খৃষ্ট ধর্মের যীশুর মত, গ্রেনয় এরপর স্বেচ্ছায় নিজেকে তার ভক্তদের মাঝে বিলীন করে দেয়। নিজের আলাদা অস্তিত্ত্ব না রেখে সে অন্যদের মাঝেই কোনো একপ্রকারে নিজে টিকে থাকতে চায়।

১৯৮৫ সালে প্রকাশিত বই এটা। সায়েন্স ফিকশন ঘরানার বই বলা যেতে পারে। বাংলায় এই প্রথম অনুবাদ হল। নিঃসন্দেহে পাঠককে অনেক কিছু ভাবাতে বাধ্য করবে বইটা।

আউট অফ দ্য ডার্ক

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে একটা নতুন হতাশাগ্রস্থ জেনারেশন দেখা যায়। তাদের ফ্যামিলি মেম্বর,পরিচিত বন্ধুবান্ধব অনেকেই দেখা যায়, যুদ্ধে মারা গেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা এখন কি করবে? লেখাপড়া, ক্যারিয়ার, ফ্যামিলি দিয়ে কি করবে?

হতাশ হয়ে তারা লেখাপড়া বা ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। Hippy নামে পরিচিত এই জেনারেশন। অপ্রচলিত পোষাক আশাক, অপ্রচলিত মিউজিক, অদ্ভূত লাইফ স্টাইল তারা বেছে নেয়। ড্রাগ কিংবা যৌনতার ব্যাপারেও তাদের কোনো বাছবিচার ছিল না। তারা বলত, এগুলা অশ্লীলতা নয়, বরং যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দুক দিয়ে মানুষ খুন করা হল অশ্লীলতা। তারা বলত, no war,make love. শিল্প সাহিত্যে বিভিন্ন সময়েই এদের উল্লেখ পাওয়া যায় ( যেমন – ফরেস্ট গাম্প সিনেমার নায়িকা ছিল হিপি)

লেখক প্যাট্রিক মোদিয়ানো, যার জন্ম একটা ফ্রেঞ্চ ইহুদি পরিবারে, যুদ্ধের কারনে অনেক প্যারা খাইতে হইছে। তার জীবনের সেই সকল কাহিনীই ফুটিয়ে তুলেছেন তার সাহিত্যে৷ তার সাহিত্যগুলাকে বলা হয় Autofiction , মানে Autobiography ( আত্মজীবনী) এবং Historical Fiction ( ইতিহাস নির্ভর কল্পকাহিনী) এর মিশেল।

Out of the dark বইটাও তেমন। ১৯৬৫ সালের কাছাকাছি সময়ের কাহিনী এটা। লেখক এখানে হিপি সুলভ জীবন কাটাচ্ছে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে বই বিক্রি করছে, নাটক লেখার চেষ্টা করছে। এই সময় ফ্রান্সে তার সাথে পরিচয় হয় আরেক হিপি কাপল – বিভার এবং জ্যাকলিন এর। গল্পের ধারাবাহিকতায় ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের আরো কয়েকজনের দেখা পাওয়া যায় কাহিনীর মধ্যে , যাদের প্রায় সবার মেন্টালিটিই তাদের মত।

কাহিনীর এক পর্যায়ে নায়ক ( মোদিয়ানো?) এবং জ্যাকলিন এর প্রেম হয়। তারা প্রায় শূন্য পকেট নিয়ে ঘুরে বেড়ায় প্যারিসে, লন্ডনে, আরো বিভিন্ন জায়গায়।

সুনীল গগঙ্গোপাধ্যায় তার ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে‘ এবং ‘মার্গারিট,ফুল হয়ে ফুটে আছো’ বইয়ের মধ্যে এক ফরাসী তরুণীর বর্ননা দিয়েছেন। প্যারিসে মার্গারিট আর সুনীল প্রায় শূন্য পকেট নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, নিজেদেরকে আবিষ্কার করতেন, আবিষ্কার করতেন প্যারিস শহরকে। এটাই ছিল সুনীলের জীবনের বেস্ট কয়েক মাস।

কিন্তু এরপর মার্গারিট এর সাথে সুনীলের বিচ্ছেদ ঘটে। তাকে আর খুজে পান নি লেখক।

প্যাট্রিক মোদিয়ানো এই দিক দিয়ে লাকি। জ্যাকলিন এর সাথে কয়েক মাস প্রেমের পরে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে৷ ৩০ বছর পরে তার সাথে আবার একবার দেখা হয় বটে, কিন্তু পুরনো আবেগ উচ্ছাস তখন আর কিছুই ছিল না। এক ধরনের স্বপ্নভঙ্গ বলা যায় মনে হয়। এর চেয়ে সুনীল এর মার্গারিটের স্টাইলে দেখা না হওয়াই কি ভাল ছিল না?

দুইটা বই সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। পারফিউম এ গ্রেনয় এর সাইকোলজি অনেক সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সংলাপ এর বদলে এখানে চিন্তামূলক প্যারাগ্রাফ অনেক বেশি। আউট অফ দ্য ডার্ক এ সাইকোলজি প্রায় কিছুই দেখানো হয়নি। জাস্ট ঘটনাগুলো বর্ননা করা হয়েছে বেশ দ্রুত স্পিডে। পাঠকের নিজের দায়িত্ব, চরিত্রগুলোর মনোজগত বিশ্লেষণ করার।

দুইটা আলাদা ধরনের অনুবাদেই অনুবাদক পায়েল মন্ডল বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন বলতে হবে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *